গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা

জাফর ওয়াজেদ: গণমানুষের রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা অর্জন করেছেন অসংখ্য সম্মাননা ও স্বীকৃতি। জনগণের ক্ষমতায়নে আলোকিত প্রিয় স্বদেশ শেখ হাসিনার কর্মেই আজ সারা বিশ্বে সমুজ্জ্বল। বিদেশি মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রতিবেদন আর প্রকাশ করে না। তবে স্বাধীনতাবিরোধী ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির ধারক-বাহকরা গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিকমাধ্যমে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকে হেয় করার জন্য মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। অসম্পাদিত এসব মাধ্যম আর যা-ই হোক, ধোপে টেকে না। বিশ্ব গণমাধ্যম তার সার্বিক কর্মকাø পর্যালোচনা করে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত করেছে।

শুধু গণমাধ্যমই নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি এবং বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছে। গণমাধ্যমে তাই শেখ হাসিনার ছিল নানামুখী উপস্থিতি। জাতিসংঘে ভাষণই বাংলাদেশ সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে অনুকরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে এমডিজির ‘রোল মডেল।’ যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল-২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩১তম দেশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বিশ্ব আজ জানতে চায় সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশে এমন কী ঘটেছে, যার ফলে এখানে দারিদ্র্যের হার ৯০ দশকের ৫৬ দশমিক ৭ থেকে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে। যাতে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে। গড় আয়ু বেড়েছে অনেক। শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে এ অভাবনীয় সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন করেছে। শিক্ষার হারও বেড়েছে। যেসব বিদেশি গণমাধ্যম এক সময় হতাশা ছড়াত, তারাই এখন প্রশংসাসূচক লেখা লেখে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, অর্থনীতির বিস্ময়, টেকসই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

২০১৮ সালের ১৩ মার্চ সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেনে শেখ হাসিনার নামে একটি অর্কিডের নামকরণ করা হয়। তাকে ইতিবাচকভাবেই মূল্যায়ন করে আসছে গত ১১ বছর ধরেই। দেশকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার ক্ষেত্রে দক্ষ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা।

গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রথম আসেন ১৯৬৯ সালে ইডেন কলেজের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে। বিজয়ের পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। মহিলাদের পত্রিকা সাপ্তাহিক ললনা ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বরে তার সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। তখন নাম ছিল হাসিনা শেখ। সেখানে তিনি দুই পাকিস্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে যে বৈষম্য, তা তুলে ধরেছিলেন। শেখ হাসিনা এরপর গণমাধ্যমে আসেন পঁচাত্তরে, ১৫ আগস্টের পর। বাংলাদেশের মানুষ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অবস্থান জানার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু ক্ষমতা দখলবাজ সামরিক জান্তারা দেশবাসীকে তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্যই প্রদান করেনি। গণমাধ্যমগুলোও ছিল নিশ্চুপ, নির্বিকার।

১৯৭৫-এর ১৮ আগস্ট জার্মানির ‘ডি ভেল্ট’ পত্রিকায় ক্লাউস বর্ন ও উলরিশ লুকের যৌথ নামে তিনটি ছবিসহ চার কলামের একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘বনে শোকাগ্রস্ত শেখ মুজিবের কন্যারা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নিয়ে প্রথম প্রতিবেদন ছাপা হয় ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট। তখন তারা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী বনে অবস্থান করছিলেন। এর আগে তারা ব্রাসেলস থেকে এখানে আসেন। সেখানকার পত্রিকা ‘ডি ডেজ’ তিনটি আলোকচিত্রসহ চার কলামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘বনে শোকাগ্রস্ত শেখ মুজিবের কন্যারা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘বাংলাদেশের সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার সঙ্গে আরও নিহত হয়েছেন তার স্ত্রী ও তিন সন্তান। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো শেখ মুজিবের দুই কন্যা কোথায়Ñ তা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে।’ দুই সাংবাদিক ক্লাউস কর্ন ও উলরিশলুকের যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ‘আমরা ডিভেল্ট পত্রিকার পক্ষ থেকে দুই কন্যার সঙ্গে কথা বলেছি। গত শুক্রবার তাদের বাবা নিহত হবার পর থেকেই তারা উভয়ই বনে অ্যাম লেবিং সড়কের ছয় নম্বরে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কোয়েনিগসভিন্টারের বাসায় অবস্থান করছেন। সাদা রঙের ভিলা-সদৃশ্য বাড়িটিতে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর সঙ্গে তার স্ত্রী মাহজাবিন চৌধুরীও বাস করেন। বাড়িটির সামনে দিয়ে পিটার্সবার্গ কুর হোটেলে যাওয়ার মূল রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে শত শত গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু এই গাড়ির আরোহীরা কেউ জানে না যে, সবুজ ঝাউঘেরা ভিলা বাড়িটিতে দুটি মেয়ে গত শুক্রবার তাদের বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকে মুহ্যমান হয়ে রয়েছে। বড় মেয়েটির নাম হাসিনা, বয়স ২৬ আর তার চেয়ে ১০ বছরের ছোট বোনটির নাম রেহানা।’ প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মীর কোলে শিশুকন্যা পুতুল, পাশে শিশু জয়। নিচে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দুই সাংবাদিক। (তথ্যদূত ‘প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন’, সরাফ আহমেদ)।

পঁচাত্তরের ২৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পৌঁছান বন থেকে। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালে শেখ হাসিনা আকাশবাণীর বাংলা সার্ভিসের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। সাংবাদিক বিবেক শুক্লা লিখেছিলেন, প্রণব মুখার্জী আকাশবাণীর বাংলা সার্ভিসের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে যুক্ত করে দেন। যাতে তিনি অপরিচিত দিল্লি মহানগরে সময় কাটাতে পারেন। শেখ হাসিনা সেখানে কারেন্ট এফেয়ার্স প্যাকেজগুলোতে অংশ নিতেন। তবে স্বনামে অংশ নেননি। দি পাইনিয়র পত্রিকায় এই সাংবাদিক শেখ হাসিনার প্রতি প্রণব মুখার্জীর পরিবারের সম্পর্কের গভীরতাও উল্লেখ করেছেন। ‘এ মুহূর্তে ডটকম’-এর সন্দীপ সিনহাও উভয় পরিবারের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। ধারণা করা যায়, আকাশবাণীতে কর্মরত থাকাবস্থায় শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্স হলে ১৫ আগস্ট হত্যাকাø সম্পর্কে আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন, যা ছিল লন্ডনে প্রথম রাজনৈতিক সভা। লন্ডনের স্থানীয় বাংলা কাগজগুলোতে তা ছাপা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনা সভাপতি নির্বাচিত হন। কাউন্সিলের আগে দেশের সংবাদপত্রে শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। তারও আগে সামরিক জান্তা শাসকদের নিয়ন্ত্রিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় দিল্লি প্রবাসী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ছেপেছিল। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছিল তাতে। শেখ হাসিনা যা বলেননি, তাও সন্নিবেশিত ছিল। শেখ হাসিনাকে নিয়ে জল্পনা-কল্পনাধর্মী অনেক প্রতিবেদনই ছাপা হয়েছিল সে সময়। ক্ষমতা দখলকারী জান্তারা তাকে নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করেছিল পরিবারের সদস্যসহ। পিতা-মাতা-স্বজনদের কবর জিয়ারত ও ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের জন্য দেশে আসার সুযোগও দেয়নি। এতই নির্মম-নিষ্ঠুর ছিল তারা। শেখ হাসিনা যেদিন দেশে ফেরেন, তার পরদিন সংবাদপত্রগুলোতে কোথাও প্রথম শিরোনাম, কোথাও দ্বিতীয় শিরোনাম হয়েছিল। মানিক মিয়া এভিনিউতে ক্রন্দনমথিত তার ভাষণ সংবাদপত্রে পাঠ করে পাঠক অশ্রুসজল হয়েছিল। সেদিন রাজপথে মানুষের ঢল নেমেছিল। শাসকরা গতিরোধ করতে পারেনি। রাস্তার দু’পাশে ছিল মানুষের ঢল। ছিল ট্রাক, বাস, মোটরসাইকেলে সারিবদ্ধ শোভাযাত্রা। দেশে ফিরেও তিনি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে পারেননি। মা-বাবা, ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের স্মৃতি স্পর্শ করতে পারেননি। শেখ হাসিনা রাস্তার ওপরই বসে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়েন। ১৯৮১ সালের ১২ জুন বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। সে সময় অনেক পত্রিকার প্রতিবেদন ছিল মর্মস্পর্শী। রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার পর বিচারপতি সাত্তার সরকারের সাময়িক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার পর রাজনৈতিক কর্মকাø প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ’৮৩ সালে শেখ হাসিনাকে আটক করা হয়। সামরিক যোদ্ধার সেন্সরশিপ থাকলেও সাহসী সংবাদপত্রগুলো প্রতিবাদ মিছিল এবং সমবেদনার ছবিও ছেপেছিল। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের একটি অংশ শেখ হাসিনার সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। তার প্যারালাল এক জেনারেলের স্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য প্রগতিশীল বলে পরিচিত সংবাদপত্রগুলোও ভূমিকা পালন করেছিল। মিডিয়া ক্যু, মার্শাল ক্যুর মাধ্যমে নির্বাচনি আসন ছিনিয়ে নিয়েছিল শাসকরা। তখন শেখ হাসিনার ভূমিকা গুরুত্ব পেয়েছিল সংবাদপত্রে।

প্রায় চার দশকের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনাকে দেশি-বিদেশি অনেক গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বলিষ্ঠ ভূমিকায় তিনি সপ্রতিভূ এখনো। বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে দৃঢ়তার সঙ্গে তার লক্ষ্যকে তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ দেখা যায়, কভিড-১৯-এর প্রকোপ বিশ্বজুড়ে যখন তীব্র, বাংলাদেশও তার থেকে মুক্ত ছিল না। গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা জাতিসংঘের ভার্চুয়াল অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘এ মহামারির কারণে আজ সারা বিশ্বের মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। কভিড-১৯ প্রমাণ করেছে আমাদের সবার ভাগ্য একই সূত্রে গাঁথা।’ তিনি এমনটাও বলেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যেমন জাতিসংঘ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের সব দেশের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি এই মহামারিও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সঠিক নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।’ প্রধানমন্ত্রী করোনা ভ্যাকসিন যাতে সব দেশ পায়, সে জন্য ওষুধ প্রস্তুতকারী দেশগুলোর প্রতিও আহ্বান জানিয়েছিলেন। করোনাকালে দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই শুধু নয়, বিনা মূল্যে করোনার তিন ডোজ টিকাদানেরও ব্যবস্থা করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলো, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিচের দিকে। শেখ হাসিনা কভিডকালে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ইতিবাচকভাবেই এসেছে।

পিআইডি নিবন্ধ