Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 7:40 pm

গণহত্যা: অক্টোবর ’৭১

কাজী সালমা সুলতানা: বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের প্রায় সারাবছর ধরেই সমগ্র দেশজুড়ে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে যেসব গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়।

শংকর মাধবপুর গণহত্যা: কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় ২ অক্টোবর ১৯৭১। এই গণহত্যা সংঘটিত হয় কোদালকাঠি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুর, সাজাই, চর সাজাই, তেররশী, কোদালকাঠি এবং পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের ভেলামারী গ্রামগুলোতে। এদিন পাকিস্তানি সেনারা মাত্র ৫ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই গণহত্যায় শংকর মাধবপুর ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর মূল লক্ষ্যস্থল।

২ অক্টোবর, ১৯৭১। সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কোদালকাঠি এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের প্রতিরোধ স্পৃহার কারণে তারা আবারও ফিরে আসে। ফিরেই তারা শংকর মাধবপুর, সাজাই, চর সাজাই, তেররশী, কোদালকাঠি এবং পার্শ^বর্তী গ্রামগুলো থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে নিয়ে আসে। তাদের দিয়ে নিহত পাকিস্তানিদের মৃতদেহ ও তাদের মালামাল লঞ্চে তুলে নেয়। এরপর শুরু করে নির্বিচারে গণহত্যা।

পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় গ্রামে ঢুকে ৬৫-৭০ জনকে জড়ো করে সবাইকে লাইন করে দাঁড় করায় ও তাদের ওপর ব্রাশফায়ার শুরু করে। এতে ঘটনাস্থলেই অধিকাংশই নিহত হয়। এ গণহত্যায় নিহতরা বেশিরভাগই দাফন-কাফন ছাড়াই পড়ে থাকে।শিয়াল-কুকুর-শকুন এসব লাশগুলোকে খুবলে খায়। গ্রামগুলো পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় তাদের দাফন করাও সম্ভব হয়নি। শংকর মাধবপুর গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই লাশের স্তূপ ছিল। বেশ কয়েকদিন পর বিকৃত হয়ে যাওয়া লাশগুলো এলাকাবাসী ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মিলে মাটিচাপা দেয়। 

সূর্যমণি গণহত্যা : পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার সূর্যমণি গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর। এদিন ভোররাতে উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের ২৫ হিন্দু বাঙালিকে এক দড়িতে বেঁধে স্থানীয় রাজাকার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। ৬ অক্টোবর ভোররাতে মঠবাড়িয়ার হিন্দু অধ্যুষিত আঙ্গুলকাটা গ্রাম থেকে ৩৭ জন নিরপরাধ হিন্দু বাঙালিকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দোসর স্থানীয় রাজাকার বাহিনী। ওই রাতে ৫০-৬০ জনের স্থানীয়ভাবে সংগঠিত একটি রাজাকার বাহিনী গ্রামে হানা দিয়ে ব্যাপক ধরপাকড় ও লুটপাট চালায়। ৩৭ জন হিন্দু বাঙালিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বাড়ি থেকে তুলে নেয়। তাদের মধ্যে ৭ জনকে রাতভর মঠবাড়িয়া থানায় আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পরের দিন মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময় সাতজনকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাকি ৩০ জনকে মঠবাড়িয়া শহর থেকে আড়াই কিলোটিার দূরে সূর্যমণি বেড়িবাঁধের ওপর এক লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।

এ সময় ভাগ্যক্রমে গুলি খেয়ে পাঁচজন বেঁচে গেলে বাকি ২৫ জন ঘটনাস্থলেই সেদিন শহিদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, সমর্থন ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের ওপর এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়।

সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন তারা হলেনÑজিতেন্দ্র নাথ মিত্র, শৈলেন মিত্র, বিনোদ বিহারী, ফণীভূষণ মিত্র, ঝন্টু মিত্র, নগেন কির্তনীয়া, অমল মিত্র, সুধাংশ হালদার, মধুসূদন হালদার, প্রিয়নাথ হালদার, সীতানাথ হাওলাদার, অন্নদা হাওলাদার, অনিল হাওলাদার, হিমাংশু মাঝি, জিতেন মাঝি, সুধীর মাস্টার, অমেলেন্দু হাওলাদার, অচীন মিত্র, অরুণ মিত্র, নিরোধ পাইক ও কমল মণ্ডল।

২০০১ সালে সূর্যমণি গণহত্যার ঘটনায় বিচার দাবিতে সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্ত রায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়।

চড়াইহাট গণহত্যা : দিনাজপুরের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা চড়ারহাট গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর বিরামপুর উপজেলার আলতাদিঘী নামক স্থানে গরুর গাড়িতে করে কয়েকজন খান সেনা বিরামপুর ক্যাম্পে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত হামলা করে ৭ জন খান সেনাকে হত্যা করে। খান সেনাদের সঙ্গে ২ জন রাজাকারও ছিল। ওই রাজাকাররা খান সেনাদের হত্যা করার খবর বিরামপুর ক্যাম্পে জানায়। খবর পেয়ে ক্যাম্প কমান্ডার একজন মেজর প্রতিশোধ নিতে হিংস্র হয়ে ওঠে। পরে তার ফোর্সদের নিয়ে ৯ অক্টোবর রাতেই পুটিমারা ইউনিয়নের চড়ারহাট (প্রাণকৃষ্ণপুর) ও আন্দোলগ্রাম (সারাইপাড়া) ঘেরাও করে।

১০ অক্টোবর ভোররাতে নবাবগঞ্জের পুটিমারা ইউনিয়নের চড়ারহাট প্রাণকৃষ্ণপুরে পুরুষদের একত্র করে গ্রামের পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে একটি বীজ তলায় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবর্ষণ থেকে চড়ারহাট গ্রামের ৮ ব্যক্তি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। বেঁচে থাকলেও তারা পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া গুলির আঘাতের ক্ষত আর স্বজন হারানোর বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন। আন্দোলগ্রামেও পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিনের ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া বাবা ও ভাইকে হারানো গুলিবিদ্ধ মোজাম্মেল হক বলেন, সেদিন তিনি ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যান। মসজিদে ১০-১২ জন নামাজ পড়ছিলেন। নামাজ শেষে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি মো. মফিজ উদ্দিনসহ অনেকেই খবর দেন, পাকিস্তানি সেনারা ডাকছে। ভাঙা সেতু নির্মাণ করতে মাটি কাটতে হবে। পাকিস্তানি সেনাদের কথা শুনেই বুকটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু মুরব্বিদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে সবাই গ্রামের পূর্ব দিকে একটি মাঠে যান। গিয়ে দেখেন, সেখানে গ্রামের প্রায় সব পুরুষদের একত্র করা হয়েছে। এরপর পাকিস্তানি সেনারা নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে। এতে ২ জন মহিলাসহ ১৫৭ জন শহিদ হন। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হন। তাদের সবার লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ৯৩ জন শহিদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছিল। ওই সময় এক কবরে একাধিক শহিদের লাশ দাফন করা হয়।   

বরইতলা গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিশোরগঞ্জের বরইতলা গণহত্যা সংঘটিত করে। এদিন পাকিস্তানি বাহিনী একসঙ্গে হত্যা করে ৩৬৫ জন নিরীহ মানুষকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ির অংশ হওয়ায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের বিশেষ টার্গেট ছিল ওই এলাকা। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর বুধবার সকালে সেনাবাহিনীর একটি দল ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের (তৎকালীন মহকুমা) নিকটবর্তী কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিলÑবড়ইতলাসহ আশপাশের গ্রামের মানুষজনকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে সংগঠিত করা। কিন্তু বড়ইতলা গ্রামে প্রবেশের পর পথ হারিয়ে ফেলার কারণে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য দলছুট হয়ে পড়ে। পরে একজন সদস্যের স্বল্পতার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে গুজব ছড়িয়ে দেয়, গ্রামবাসী পাকিস্তানি সেনাকে গুম করে ফেলেছে। এ সংবাদের সত্যতা যাচাই না করেই পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা, চিকনির চর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ি, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর ও ভূবিরচর গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোককে জোর করে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে বড়ইতলা গ্রামের একটি স্থানে জড়ো করে। একপর্যায়ে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে সেদিন ৩৬৫ জন নিহত এবং আরও দেড় শতাধিক ব্যক্তি মারাত্মক আহত হন।

এই হত্যাযজ্ঞে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পূর্ব চিকনিরচর গ্রাম। এখানকার বহু মানুষকে হত্যাসহ জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো গ্রামটিকে। পুরো বড়ইতলা ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক গণকবর। প্রতিটি পরিবারই হারিয়েছে কোনো না কোনো স্বজনকে।

সূত্র: ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্ট

সাংবাদিক