গণহত্যা সেপ্টেম্বর ’৭১

কাজী সালমা সুলতানা: বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বিনাশ করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একাত্তরের প্রায় সারা বছর ধরেই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। এসব গণহত্যায় ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে এই সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। হত্যার সঙ্গে নির্যাতন করা হয়েছে ছয় লাখেরও বেশি নারীকে। এছাড়া নিপীড়িত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা কত ঘরবাড়ি ভস্মীভূত করেছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। এখন পর্যন্ত দেশে পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়।

রানীগঞ্জ গণহত্যা : ৩১ আগস্ট শ্রীরামসী গণহত্যার পরদিন ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় কিছু দোসর জগন্নাথপুর উপজেলার প্রাচীনতম রানীগঞ্জ বাজারে গুলি চালিয়ে প্রায় দু’শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। সেই সঙ্গে পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পুরো রানীগঞ্জ বাজার।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রানীগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করত। বিষয়টি স্থানীয় কিছু দোসর পাক হানাদারদের জানিয়ে দেয়। এরপরই সেদিন শান্তি কমিটি গঠনের কথা বলে স্থানীয় রাজাকাররা বাজার ব্যবসায়ী, বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা লোকজন, বড় বড় নৌকার মাঝিসহ প্রায় দুই শতাধিক মানুষকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বাজারের একটি দোকানে জমায়েত করে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাজাকাররা তাদের সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এভাবে পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কুশিয়ারা নদীর তীরে। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পেছন দিক থেকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

ইতিহাসের বর্বর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে দুই শতাধিক লোক শহিদ হলেও হত্যাযজ্ঞের পর ৩৪ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যদের পরিচয় আজও পাওয়া যায়নি।

কৃষ্ণপুর গণহত্যা:  একাত্তরের ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের লাখাই ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল পৈশাচিক কায়দায় গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় ১২৭ জন নিরীহ বাঙালি শহিদ হন।

গণহত্যার দুই দিন আগে ১৬ সেপ্টেম্বর, রাজাকাররা গভীর রাতে নৌকায় এসে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টার দিকে পার্শ্ববর্তী কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল দুটি স্পিডবোটে করে কৃষ্ণপুর গ্রামে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখাই উপজেলার মুড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুরের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়ার নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জনের একদল রাজাকার-আলবদর। স্পিডবোটগুলো থেকে পাকহানাদাররা নেমে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে গ্রামে ঢুকেই নির্বিচারে গুলি ছুড়তে শুরু করে। এ সময়ে রাজাকারেরাও গ্রামের চারপাশ থেকে গুলি করতে থাকে এবং গ্রামে লুটপাট শুরু করে। লুটপাটের পর হানাদার ও রাজাকারেরা ১৩০ জন নিরীহ মানুষকে কমলাময়ী উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। রাজাকারেরা শহিদদের লাশ পার্শ্ববর্তী বলভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দেয় এবং গান পাউডার দিয়ে গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেন। এছাড়া গ্রামের নিরীহ নারীদের সম্ভ্রমহানি করে তারা। এ সময় হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ মজা পুকুরে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেন। হানাদাররা চলে গেলে তারা হত্যাযজ্ঞস্থল থেকে লাশগুলো উদ্ধার করে স্থানীয় বলভদ্র নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন। এদিন হানাদারদের গুলি খেয়েও মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থেকে প্রাণে রক্ষা পান প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায়, হরিদাস রায় ও মন্টু রায়। ২০১০ সালের ১২ আগস্ট, কৃষ্ণপুর গণহত্যা,

মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম মামলা হিসেবে সিলেট বিভাগ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বারা গৃহীত হয়।

চণ্ডীপুর গণহত্যা: কৃষ্ণপুরে পৈশাচিক গণহত্যা চালানোর পর পাকহানাদারেরা পার্শ্ববর্তী চণ্ডীপুরে যায়। এই গ্রামে মাত্র ১৬টি পরিবার বসবাস করত। গ্রামের বাসিন্দাদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হানাদার বাহিনী। এ সময় ২ জন গ্রামবাসী ছাড়া সবাই হত্যার শিকার হন।

লালচাঁদপুর গণহত্যা: ১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের লালচাঁদপুর এলাকায় স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদারেরা মধু নমঃশূদ্রের বাড়িতে প্রবেশ করে ৪০ জন সনাতন ধর্মাবলম্বীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেঁধে রেখে পুরো বাড়িতে লুটপাট চালায়। এরপর তাদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। তারপর গান পাউডার দিয়ে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

মাহমুদপুর গণহত্যা: একাত্তরের ২৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের গোপালপুরের মাহমুদপুর-পানকাতায় গণহত্যা সংঘটিত হয়। এ দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল প্রায় দ্্্্্্্্ুই শতাধিক রাজাকার-আলবদর সদস্যকে নিয়ে মাহমুদপুর গ্রামে প্রবেশ করে। তারা তৎকালীন এমএনএ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রয়াত হাতেম আলী তালুকদারের বাড়ি হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রাম এবং আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত পাশের পানকাতা, বলিভদ্র, কেরামজানী, সয়া ও ইস্পঞ্জিরাপুর গ্রাম গুঁড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশে আক্রমণ চালায়। তারা প্রথমে তিনজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে লুটপাট করতে থাকে।

এ সময় ধনবাড়ী উপজেলার কেরামজানী বাজারে অবস্থান করা কাদেরিয়া বাহিনীর ‘হনুমান’ কোম্পানির কমান্ডার কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙাল তার সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে পানকাতা গ্রামে পৌঁছে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধ চলে। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলেও হানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে তারা থামিয়ে দিতে সমর্থ হন। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কেউ হতাহত না হলেও হানাদার বাহিনীর এক সেনাসহ তিনজন গুরুতর আহত হয়। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবল উš§াদনা ও হিংস তায় আশপাশের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। তারা হাদিরা ইউনিয়নের মাহমুদপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতা গ্রামে নৃশংসভাবে গণহত্যা চালিয়ে পানকাতা গ্রামের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

তারা শতাধিক নিরীহ মানুষকে আটক করে পানকাতা মাঠের ঈদগাহ মাঠে ব্রাশফায়ার করে ২৩ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এছাড়া তারা ৫০-৬০টি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ব্যাপক লুটতরাজসহ আরও ৬০-৬৫ গ্রামবাসীকে গুরুতর আহত করে। হতাহতদের অনেকে এখনো পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে।

তথ্যসুত্র : ১৯৭১ গণহত্যা ও নির্যাতন আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্ট

লেখক: সাংবাদিক

salma15august@gmail.com