Print Date & Time : 6 September 2025 Saturday 1:12 am

গর্ভবতী মায়ের যত্ন

সেলিমা খাতুন: গর্ভকালে মায়েদের সবসময় থাকতে হয় একটু আলাদা যত্নে, একটু বেশিই সাবধানে। গর্ভধারণের সময় থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সময়কালে মা ও শিশুর যত্নকে গর্ভকালীন যত্ন বলে। এই গর্ভকালীন যত্নের লক্ষ্য হলো মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা প্রতিরোধ বা চিকিৎসা করা। এককথায় মায়ের স্বাস্থ্যের কোনো অবনতি না করে সমাজকে একটি সুস্থ শিশু উপহার দেয়াই গর্ভকালীন যত্নের মূল লক্ষ্য।

গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা গর্ভবতীর স্বামীসহ পরিবারের অন্য সবার সমান দায়িত্ব। গর্ভধারণের পরপরই গর্ভবতী নরীর গর্ভকালীন যতেœর জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রথম ভিজিটের পর একজন গর্ভবতীকে সাধারণত ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিমাসে একবার, ৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৫ দিনে একবার এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে একবার গর্ভকালীন যতেœর জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। পাঁচ থেকে আট মাসের মধ্যে দুটি টিটি টিকা নিতে হয়। বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার ও প্রচুর পরিমাণ পানি পান করা উচিত এ সময়। গর্ভকালে ভারী কোনো কাজ করা উচিত নয়। এ সময় সবসময় হাসিখুশি থাকতে হবে এবং দিনে এক থেকে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম ও রাতে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। যেকোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা ক্লিনিকে সন্তান প্রসব করানো নিরাপদ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রী দ্বারা সন্তান প্রসব করাতে হবে। তবে গর্ভকালে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে অতি দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে গর্ভবতী মাকে।

গর্ভকালে মায়েদের পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার একটু বেশিই খেতে হয়। বাড়তি খাবার গ্রহণের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে গর্ভের সন্তানের ওপরও। অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় মা যদি নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হয়, তবে মা নিজে যেমন সুস্থ থাকবে, তেমনি সুস্থ-সবল সন্তান জন্ম দেয়ার সম্ভাবনাও থাকবে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ।

গর্ভাবস্থায় শিশুর সুস্থ বৃদ্ধি ও বিকাশে পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গর্ভধারণের প্রায় তিন মাস থেকে ফোলেটসহ প্রারম্ভিক ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত। গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে খাদ্য উন্নয়নশীল ভ্রূণের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় মা ও গর্ভের শিশু দুজনের সুস্থতার জন্যই একটু বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে, বিশেষ করে শিশু বেড়ে ওঠার জন্য আমিষজাতীয় খাবার, যেমন মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ও দুধ বেশি করে খেতে হবে। এছাড়া সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, তরকারি ও ফল ছাড়াও যেসব খাবারে আয়রন বেশি আছে, যেমন কাঁচা কলা, পালংশাক, কচু, কচুশাক, কলিজা ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে। এ মাসে বেশি পরিমাণে পানি, দিনে আট-দশ গ্লাস অবশ্যই খেতে হবে। রান্নায় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করতে হবে, যা গর্ভবতী মা, শিশুসহ সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অনেকেরই ধারণা মা বেশি খেলে পেটের বাচ্চা বড় হয়ে যাবে এবং স্বাভাবিক প্রসব হবে না। অনেকে গর্ভবতী মাকে বিশেষ কিছু খাবার, যেমন দুধ, মাংস কিছু কিছু মাছ ইত্যাদি খেতে নিষেধ করে। এগুলো খাওয়া তো নিষেধ নয়ই, বরং এসব খাবার মা বেশি খেলে মা ও বাচ্চা দুজনের স্বাস্থ্যই ভালো থাকবে। মা প্রসবের ধকল সহ্য করার মতো শক্তি পাবে এবং মায়ের বুকে বেশি দুধ তৈরি হবে।

গর্ভবতী মায়ের এসময় স্বাভাবিক কাজকর্ম করা শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু কিছু ভারী কাজ, যেমন কাপড় ধোয়া, পানিভর্তি কলসি কাঁখে নেয়া এবং ভারী বালতি বা হাঁড়ি তোলা উচিত নয়। এ সময় প্রতিদিন গোসল করা, দাঁত মাজা, চুল আঁচড়ানো এবং পরিষ্কার কাপড় পরা উচিত। এতে শরীর ও মন ভালো থাকে।

গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা বা চেকআপের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে মা ও গর্ভস্থ শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গর্ভবতী মাকে গর্ভকালে কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চেকআপের জন্য যাওয়ার সুপারিশ করেছে। এর মাধ্যমে ছয়টি সেবা নিশ্চিত করা হয়। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, গর্ভবতী মায়ের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুযায়ী চারবারের বেশিও চেকআপে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

গর্ভকালে সেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ব্যাপক। কারণ এ সেবার আওতায় থাকলে প্রথমেই চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবাদান কর্মী সঠিকভাবে বলে দিতে পারবে গর্ভধারণ হয়েছে কি না। সেবাদানকারী সন্তানের বয়স সঠিকভাবে নির্ণয় করে সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ বলে দিতে পারবে। এতে সন্তান নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে জন্ম হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। গর্ভবতীর কোনো স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে চিকিৎসক এ সময় চিকিৎসা দিতে পারবে। গর্ভবতী মা সময়মতো প্রয়োজনীয় টিকা নিতে পারবে। পাশাপাশি টিকা সেবাদানকারী বা চিকিৎসক গর্ভবতী মাকে সঠিক ও সুষম খাবারের তালিকা দিতে পারবে, যাতে একটি সুস্থ সন্তান জন্মলাভ করে। সেবাদানকারী বা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্থান নির্বাচন করা যায়। এজন্য কত টাকা লাগতে পারে, যাতায়াত, রক্তের প্রয়োজনীয়তা, হাসপাতালের অবস্থানের সময়কাল প্রভৃতি বিষয়ে উপদেশ ও পরামর্শ পাওয়া যায়। পুরো গর্ভাবস্থায় যদি কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সমস্যা দেখা দেয়, তা প্রথম থেকেই নির্ণয় করে সঠিক সময়ে সঠিক সেবা নেয়া যায়।

গর্ভধারণের ১৮-২০ সপ্তাহ পর থেকে বাচ্চার নড়াচড়া মা বুঝতে পারে। পেটে বাচ্চার নড়াচড়া বাচ্চার সুস্থতা সম্বন্ধে ধারণা দিয়ে থাকে। একটি সুস্থ বাচ্চা স্বাভাবিক অবস্থায় ১২ ঘণ্টায় ১০ বার নড়াচড়া করে। গর্ভবতী মা গর্ভের শিশুর ১২ ঘণ্টায় ১০ বার নড়াচড়া পেয়ে থাকলে বুঝতে হবে গর্ভে বাচ্চা সুস্থ আছে। যদি নড়াচড়া ১২ ঘণ্টায় ১০ বার না পেয়ে ছয় থেকে আটবার নড়াচড়া পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই মাকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন হলে জরুরি প্রসূতিসেবা নিতে হবে। জরুরি প্রসূতিসেবা হলো জরুরি ভিত্তিতে প্রদানযোগ্য জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা বা সেবা, যার মাধ্যমে প্রসবজনিত জটিলতার কারণে নারীদের মৃত্যু ও অসুস্থতা থেকে রক্ষা করা যায়।

গর্ভকালে পাঁচটি বিপদচিহ্ন খেয়াল রাখা জরুরি। এ চিহ্নগুলো হলো- গর্ভাবস্থায় রক্তস্রাব, মাথাব্যথা ও চোখে ঝাপসা দেখা, গর্ভাবস্থা, প্রসবের সময় বা প্রসবের পর খিঁচুনি, ভীষণ জ্বর এবং বিলম্বিত প্রসব। গর্ভকালে ও প্রসবকালে এর যে কোনো একটি জটিলতা দেখা দিলে দেরি না করে জরুরি সেবার জন্য গর্ভবতী মাকে দ্রুত হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। জেলা হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে।

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারলে মা ও শিশুর জীবন রক্ষা করা যায়। তাই গর্ভকালে, প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী সেবাগুলোর মানোন্নয়ন ও সহজলভ্য করা প্রয়োজন। গর্ভকালে পাঁচটি বিপদচিহ্ন দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ফলে মা ও শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করা রীতিমতো অপরাধ। আর এর পেছনের মূল কারণ বাল্যবিয়ে। সমন্বিত প্রচেষ্টায় বাল্যবিয়ে রোধ করা আবশ্যক, যা টেকসই উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ।

শিশু জন্মমুহূর্ত থেকে শুরু করে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত মাতৃগর্ভে অবস্থান করে। গর্ভস্থ ভ্রূণশিশুর পুষ্টি মায়ের পুষ্টির উপর নির্ভর করে। শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখতে গর্ভবতী মায়ের সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন। মা যদি অসুস্থ হয়, মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন থাকে বা নিজের যত্ন না নেয়, তাহলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য গর্ভাবস্থায় শারীরিক ও মানসিক যত্নের প্রয়োজন। আর এজন্য সবার আগে চাই সচেতনতা এবং এ সচেতনতা ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব পর্যায়েই আবশ্যক।

পিআইডি নিবন্ধ