গাংনীতে আশঙ্কাজনকহারে ছড়িয়ে পড়েছে অ্যানথ্রাক্স

মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর): মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর বর্ডার পাড়ার হামিদুল। দিন ১৫ আগে বাজার থেকে একটি গরুর ভুঁড়ি কিনে আনেন। তার দুই ভাই আনারুল, আলিমসহ তিনজনে ওই ভুঁড়ি ভাগ করে নেন। তারপর তা পরিষ্কার করে রান্না করেন স্ত্রী সাহারবানু, মেয়ে মরিয়ম, ভাবি রাহেলা ও চম্পা। এর দুদিন পরই তাদের হাতে ও মুখে ফোঁড়া ও পচন দেখা দেয়। স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে তিনি ও তার পরিবারের লোকজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। ডাক্তার জানান, তারা সবাই অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত।

শুধু হামিদুলের পরিবার নয়, গোটা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গত সাত মাসে ৪৫২ জন অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০২১ সালে একই এলাকায় অ্যানথ্রাক্স আক্রান্তের শিকার হয় ৪১৭ জন। তাদের মধ্যে আছেন ২২৯ নারী ও ১৮৮ পুরুষ। ২০২২ সালে ৫৫০ জন এবং চলতি বছরের গত সাত মাসে ৪৫২ জন অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশু থেকে তা ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে গবাদি পশুকে টিকার আওতায় আনতে পারলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত রোগীরা জানান, মাংস খাওয়ার পরপরই মুখসহ বিভিন্ন অঙ্গে চুলকানি দেখা দেয়। তারপর ফুলে যায় এবং পানি ঝরে। পরে তারা জানতে পারেন এটি অ্যানথ্রাক্স রোগ। বাড়ির পাশের লোকজনের গরু-ছাগলের অসুখ হলে তারা গোপন রেখে নিজেরাই জবাই করে স্বল্প মূল্যে মাংস বিক্রি করেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্তরা স্বল্প মূল্যে মাংস কিনে এনে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

স্থানীয় বামন্দী বাজারের কসাই ও ক্রেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত এক মাসেও কোনো লোক আসেনি গরু-ছাগল পরীক্ষা করার জন্য। এজন্য দু-একটা অসুস্থ পশু জবাই করে বিক্রির সুযোগ নিতেও পারেন মাংস বিক্রেতারা। তাছাড়া অনেক গেরস্ত ও খামারি অসুস্থ পশু জবাই করে স্থানীয়ভাবে স্বল্পমূল্যে মাংস বিক্রি করেন। ফলে অসুস্থ পশুর মাংস খেয়ে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন অ্যানথ্রাক্স রোগে।

গাংনী বাজারের মাংস ব্যবসায়ী সেকেন্দার কসাই জানান, এই বাজার পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে। এখানে কোনো অসুস্থ পশু জবাই করা হয় না। কিন্তু অন্যান্য হাটবাজারে কোনো তদারকি নেই। ফলে রোগা ও অসুস্থ গরু জবাই করা সহজ। স্থানীয় লোকজনও রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সস্তায় কিনে খায়। ফলে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এমকে রেজা জানান, সম্প্রতি গাংনী পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অ্যানথ্রাক্স রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অ্যানথ্রাক্স-আক্রান্ত গরুর মাংস কাটা, ছেঁড়া ও খাওয়ার কারণে সবাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কেউ যাতে রোগাক্রান্ত গরু জবাই করতে না পারে সেজন্য নজরদারি প্রয়োজন। তিনি আরও জানান, হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যানুযায়ী গত সাত মাসে ৪৫২ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। তারা সবাই চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং অনেকে অসুস্থ।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান জানান, সবখানেই অ্যানথ্রাক্স জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় আছে। ৪০ বছর পর্যন্ত এর জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ জীবাণু সক্রিয় হতে পারে। বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে এ রোগের বিস্তার বেড়েছে। তাছাড়া লোকবলের অভাবে তেমন কোনো তদারকি করা সম্ভব হয় না। তবে যেসব এলাকায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠক করেও সবাইকে সজাগ করা হচ্ছে।