প্রতিনিধি, গাংনী (মেহেরপুর): লেখাপড়ার পথ সুগম করতে সরকার উপবৃত্তি ভাতা চালু করলেও এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মেহেরপুরের গাংনীর অনেক শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের কাছে উপবৃত্তির তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও টাকা পাচ্ছেন না তারা। আবার অনেকের অভিযোগ, শিক্ষকদের বারবার বলার পরে কয়েকজন উপবৃত্তির টাকা পেলেও তা সঠিক সময়ে পাচ্ছে না। আবার অনেকেই উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানানো সত্ত্বেও সুরাহা না হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তাই পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা টাকা না পাওয়ায় শিক্ষকরাও নানা সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০০১ সালে শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির পরিবর্তন করে প্রথমে ছাত্রপ্রতি মাসিক ২০ টাকা হারে এবং ২০০২ সালের জুলাই থেকে শতকরা ৪০ ভাগ শিক্ষার্থীকে মাথাপিছু ১০০ টাকা করে উপবৃত্তি প্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়। বিভিন্ন চড়াই উৎরায় পেরিয়ে ২০১৯ সালের দিকে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিং ‘নগদ’ মাধ্যমে প্রদান করা হয়। যে মাধ্যমে টাকা আদান প্রদানে গ্রাহককে কোনো মেসেজ দেয়া হয় না।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ৭৫ টাকা এবং অন্যান্য শ্রেণিতে মাসিক ১৫০ টাকা করে সরকার বছরে দুইবার মোবাইলের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করে থাকেন। প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হলে টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে তা পরিবর্তন হয়ে ‘বিকাশ’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হতো। বিকাশের মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদানের সময় একটি মেসেজের মাধ্যেমে উপকারভোগীতে নিশ্চয়তা বার্তার মাধ্যমে তা জানানো হতো। পরে বিকাশ পরিবর্তন করে বর্তমানে ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা প্রদানের পর উপকারভোগীদের মোবাইলে কোনো নিশ্চয়তা বার্তা (মেসেজ) না দেয়ায় অনেকেই ধোঁয়াশায় পড়ে থাকেন। টাকা না পাওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহিতার মধ্যে পড়েন বিদ্যালয় শিক্ষকরা।
গাংনী উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১৬২টি। এসব বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সরকারি নিয়মানুযায়ী শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দিয়ে শতভাগ সব শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির সুবিধার আওতায় নিয়েছে বর্তমান সরকার। অথচ সরকারের এ প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত রয়েছেন সেসব কর্তাব্যক্তির অবহেলায় অনেক শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের।
গাংনী সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পারভেজ সাজ্জাদ রাজা বলেন, তার বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ১৫৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে ২৯ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। বিষয়টি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে জানানো হলেও কোনো সুরাহা মেলেনি। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম, আলজারির, রাধিকা জানায়, তাদের সহকর্মীরা অনেকেই উপবৃত্তির টাকা পেয়েছে। আমরা আজও পাইনি। স্যারদের মাঝে মধ্যে বলি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
বাঁশবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার জানান, ওই বিদ্যালয়ে ১৪০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। এদের মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। উপবৃত্তিবঞ্চিত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আমাদের কাছে এলেও কোনো উত্তর দিতে পারি না এমনকি আমরা কোথায় অভিযোগ করব তাও জানি না। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আছিয়া, তাছিম, উম্মে সালমা, হাবিবা, লিমা এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, শিক্ষকরা বলে তোমাদের নাম উপবৃত্তির তালিকায় আছে; কিন্তু আজও টাকা আসেনি। আমাদের কয়েকবার মোবাইল নাম্বার সঠিক আছে কিনা তা দেখা হয়েছে। সব ঠিক আছে কিন্তু টাকা আসে না।
বড় বামুন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, গোলাম হাসান জানান, বিদ্যালয়ের ৭৮ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থী এ বছর উপবৃত্তির টাকা পায়নি। পিরতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৯০ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়নি বলে জানান প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার ফয়জুন নেছা।
সাহারবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দানেসুর রহমান জানান, ১৫৬ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ জন শিক্ষার্থী এবং ভাটপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম জানান, ১৫ জন শিক্ষার্থী এ বছর বঞ্চিত হয়েছেন সরকারের এ উপবৃত্তি সহায়তা থেকে।
শিক্ষকদের অভিযোগ শিক্ষার্থীদের মোবাইল নম্বর ও কাগজপত্র সঠিক থাকা সত্ত্বেও তারা উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছেন। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে মনোমালিন্য হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরাও তাদের কোনো জবাব দিতে পারছি না। শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে স্কুল-শিক্ষকরা মনে করছেন ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টে টাকা প্রদান করা হলে মোবাইলে কোনো মেসেজ দেয়া হয় না। এতে টাকা প্রদানের বিষয়ে জানতে পারছে না উপকারভোগীরা। এভাবে অন্তত কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে উপবৃত্তির এ সুবিধা থেকে। তবে প্রকৃতপক্ষে কতজন শিক্ষার্থী উপবৃত্তি থেক বঞ্চিত রয়েছে তার কোনো সংখ্যা নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা না পাওয়ার বিষয়ে গাংনী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আলাউদ্দিন বলেন, ‘উপবৃত্তি-বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে মৌখিক অবহিত করেছেন। আমি তাদের তালিকা করে পাঠাতে বলেছি। তালিকা পেলে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।’