মজনুর রহমান আকাশ, গাংনী (মেহেরপুর): খেতে সুস্বাদু আর পুষ্টিগুণে ভরপুর জনপ্রিয় খাবার কুমড়ার বড়ি তৈরির ধুম পড়েছে গ্রামীণ জনপদে। মেহেরপুরের গাংনীও এর ব্যতিক্রম নয়। শীতের মৌসুমে কুমড়াবড়ির কদরটা একটু বেশি। বাড়ির আঙিনা, আশপাশে মাচা করে সেখানে শুকানো হচ্ছে এসব বড়ি। স্বাদে ও মান ভালো হওয়ায় দিন দিন বেড়েই চলেছে বড়ির চাহিদা। বাড়তি আয়ের পথ তৈরি হওয়ায় অন্যান্য কাজের পাশাপাশি পাড়া মহল্লায় নারীরা পালাক্রমে এই বড়ি দেয়ার কাজটি করছেন। অন্যদিকে ভোজন রসিকরাও তা খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন।
বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি কুমড়ার বড়ি তৈরি করে রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও এ কাজে হাত লাগিয়েছেন। সাধারণত শীতকালেই কুমড়াবড়ির চাহিদা বেশি থাকে। আগে সনাতন পদ্ধতিতে বড়ি তৈরি করা হতো। তখন সন্ধ্যায় ডাল ভিজিয়ে রেখে পরের দিন শিলপাটায় বেটে বড়ি তৈরি করা হতো। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন মেশিনের মাধ্যমে কুমড়ার বড়ি তৈরির ডাল ফিনিশিং করা হয়। হাটবাজারে কুমড়ার বড়ি বর্তমানে খুচরা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
কয়েকজন গৃহবধূর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, রাতে কুটা কলাই-কুমড়ার মণ্ড পাত্র করে সারারাত শীতের শিশিরে রাখা হয়। পরের দিন ভোরে গৃহিণীরা একত্রিত হয়ে বসে যান বড়ি দেয়ার কাজে। কাঠ, নেট বা বাঁশের মাচার ওপর পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে তার ওপর ধীরে ধীরে ডান হাতের মুঠোয় বসানো হয় বড়ি। হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় তারা বিশেষ কৌশলে বড়ি তৈরি করেন। এরপর কাঁচাবড়ি শীতের রোদে শুকানো হয়। বড়িগুলো যেন দেখা যায় তারার মতো ফুটে আছে। পরিষ্কার আবহাওয়া এবং তীব্র শীতে বড়ি বানালে সেই বড়ি স্বাদযুক্ত হয় বেশি।
বড়ি তৈরি সম্পর্কে গাংনীর শিমুলতলার জোসনা খাতুন জানান, বাজারে প্রতি কেজি মাস কলাইয়ের ডাল ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও গ্রামে চাল-কুমড়ার আকার হিসেবে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। প্রথমে মাস কলাইয়ের ডাল রোদে ভালো করে শুকিয়ে তারপর পানিতে ছয় ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। কুমড়ো থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নেয়ার পর এর মধ্যে কিছু মসলা দিয়ে মেশিনের সাহায্যে মিশ্রণ করে কুমড়াবড়ির জন্য উপকরণ তৈরি করা হয়। আবহাওয়া ভালো হলে কুমড়াবড়িগুলো ভালো হয়। বৈরী আবহাওয়া বা শৈতপ্রবাহের ফলে কুমড়াবড়ি নষ্ট হয়ে যায়। কুমড়াবড়ি একটি মুখরোচক খাবার। অনেকের কাছে এটি অনেক প্রিয়। এটির ফলে তরকারির স্বাদে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
বাজারে চালকুমড়ার ব্যাপক চাহিদাও লক্ষ্য করা গেছে। গ্রামে দাম কম থাকলেও শহর বাজারে খুচরা বাজারে প্রতিটি কুমড়া ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা করে বিক্রি করছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এই কুমড়া সংগ্রহ করে বাড়ির বৌ-ঝিরা বড়ি তৈরি করছেন। বড়ি তৈরি করতে পরিশ্রম বেশি হলেও লাভও হয় বেশি। আগে সব সময় কলাই পাওয়া গেলেও কুমড়া পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন বড়ি দেয়ার জন্য কুমড়াও পাওয়া যায় সব সময়। তাছাড়া আগের তুলনায় বড়ি তৈরিতে পরিশ্রম অনেক কম। আগে মেয়েরা বাড়ির ঢেঁকিতে কুমড়া ও কলাইয়ের ডাল মিহি করে কুটতো। এখন মেশিনের সাহায্যে সব করা হয়।
পুষ্টিবিদ তরিকুল ইসলাম জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম মাষকলাইতে আছে ৩৪১ মিলিগ্রাম ক্যালরি, ৯৮৩ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, প্রোটিন ২৫ গ্রাম, সোডিয়াম ৩৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম আয়রন ৭.৫৭ মিলিগ্রাম। অপরদিকে চাল-কুমড়া পুষ্টিকর একটি সবজি। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার রয়েছে তাই চাল কুমড়ার উপকারিতা অনেক। যক্ষ্মা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস্ট্রিকসহ বহু রোগের উপশম করে চালকুমড়া। চাল কুমড়া তরকারি হিসেবে খাওয়া ছাড়াও মোরব্বা, হালুয়া, পায়েস এবং পাকা কুমড়া এবং কালাই ডাল মিশিয়ে কুমড়াবড়ি তৈরি করেও খাওয়া হয়। সব মিলিয়ে কুমড়াবড়ি নিঃসন্দেহে একটি সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর খাবার বলে মন্তব্য করেন তিনি।