গাড়ি মেরামত ও সার্ভিসিংয়ের কাজে দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওয়ার্কশপ। এর অধিকাংশই চলছে বিচ্ছিন্নভাবে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির ব্যবহার করলেও অনেকে এখনও সার্ভিসিং করছেন সেকেলে ব্যবস্থায়। যদিও এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব
জাকারিয়া পলাশ: গাড়ি সার্ভিসিংয়ের জন্য প্রায় চার হাজার ধরনের ছোট-বড় যন্ত্রাংশের প্রয়োজন। এসব যন্ত্রাংশের সবই মেলে পুরান ঢাকার ধোলাইখালে। সেখানে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি, কেনাবেচা ও রিকন্ডিশনের জন্য রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি ছোট-বড় দোকান। সেখানেও বড় কোনো বিনিয়োগ নেই। নেই ভালো অবকাঠামো ও পেশাদার উদ্যোগ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ধোলাইখালে কিছু কিছু যন্ত্রাংশ তৈরি হয়। তবে সিংহভাগই হচ্ছে পুরনো যন্ত্রাংশের নতুন সংস্করণ বা রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশ। এখানে তৈরি হওয়া যন্ত্রাংশের মধ্যে প্রায় ১৩৭টি আইটেম বিশ্বের ১৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এছাড়া চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক নতুন যন্ত্রাংশ আসে। তবে রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশের কোনো বিকল্প এখনও নেই। দেশের ৬০ লাখ ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের যন্ত্রাংশ কোনো না কোনোভাবে ধোলাইখাল থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব মোটর পার্টস ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে এ খাতটি অসংগঠিত হওয়ায় সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বলে জানান তারা।
সেগুনবাগিচার একটি সার্ভিসিং সেন্টারের মিস্ত্রি সাইফুল ইসলাম (২০) জানান, গাড়ির যন্ত্রাংশের জন্য ধোলাইখাল ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। যে কোনো গাড়ি মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ কিনতে প্রায় সবাই ছুটে যান ধোলাইখালে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে এখনও জাপানি টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ির গ্রাহক সবচেয়ে বেশি। ওইসব গাড়ির মেরামত ও সার্ভিসিংয়ের জন্য রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কার্যকর। নতুন-পুরনো সব যন্ত্রাংশই পাওয়া যায় ধোলাইখালে। তবে মূল আকর্ষণ হচ্ছে রিকন্ডিশন্ড যন্ত্রাংশ সরবরাহ করা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ধোলাইখালের রাস্তার দুই ধারে পুরনো গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রপাতি কেনাবেচা হয়। টুটা-ফাটা মোটর পার্টস থেকে শুরু করে বিভিন্ন মডেলের গাড়ি, ট্রাক, ট্রাক্টর, লরি, অটোরিকশা, মেডিক্যাল বেড, ডায়নামোসহ নানা সামগ্রীর খুচরা যন্ত্রপাতি সরবরাহ হয় সেখান থেকে। শুধু যন্ত্রপাতিই নয়, বড় গাড়ি, গাড়ির ইঞ্জিন, লঞ্চের ইঞ্জিনও গড়ে তোলা হয়। এসব কাজের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে সাড়ে ছয় হাজার ছোট-বড় মোটর পার্টসের দোকান।
ছোট-বড় মিলিয়ে ধোলাইখাল এলাকায় প্রায় ৫৫টি মার্কেটে গাড়ির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। রাস্তার ওপরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টস নিয়ে বসে থাকে লোকজন। তারা পুরনো পার্টস কেনে ও বিক্রি করে। সেখানে রাবার, ব্রেকসু, গ্লাস হ্যান্ডেল, লুকিং গ্লাস, হর্নসহ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নানা যন্ত্রাংশ নিয়ে রাস্তার ওপর বসেছিলেন আহসানুল্লাহ। তিনি জানান, যন্ত্রাংশগুলো একটা দোকানে স্টোর করে রাখি। সে জন্য দৈনিক ৫০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। অন্যান্য আরও ৪০ টাকা দিতে হয় বিভিন্ন জনকে চাঁদা আর বখশিশ। বেচাকেনা হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেখানকার ওয়ার্কশপ, লেদ ইন্ডাস্ট্রি এবং পুরনো যন্ত্রাংশ কেনাবেচা ও পুরনো গাড়ি কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক ও কারিগর।
বাতিল হয়ে যাওয়া যন্ত্রাংশও ঘষে-মেজে নতুন বানাতে পারেন সেখানকার কৌশলীরা। তারা অগোছালোভাবে পরিচালনা করছেন দেশের বৃহত্তম মোটর মার্কেট। তাদেরই একজন সবুজ। তার কাছ থেকে জানা গেল, পাঁচ বছর বয়সে ধোলাইখালের মোটর পার্টসের দোকানে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৭ বছর ধরে কাজ করার পর এখন তিনি লেদ মেশিনের প্রধান মিস্ত্রি।
তার সঙ্গে কিছুক্ষণ থেকে দেখা গেল, পুরনো একটি ছোট্ট ধাতব যন্ত্রাংশকে লেদ মেশিনে বসিয়ে কেটে স্বচ্ছ করে দিচ্ছে। আর এতেই সেটি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। সবুজ জানান, একেকটি পার্টস রিকন্ডিশন্ড করতে এক থেকে দুই মিনিট সময় লাগে। এর বিনিময়ে পাচ্ছি ১০ টাকা। সারাদিন যতক্ষণ কাজ করব, ততক্ষণ এভাবেই টাকা পাব। এর কিছুটা আমি নেব আর কিছুটা দেব দোকানের মালিককে। এ অবস্থানে আসতে লেগেছে ১৭ বছর। অনেক ওস্তাদের সঙ্গে কাজ করে লেদ মেশিন চালাতে শিখেছি। তবে বেশিদিন সেখানে থাকতে নারাজ তিনি। জানান, কিছুদিন পর নিজেই আরেকটি গ্যারেজ দিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন। এভাবেই কিছুদিন পরপর নতুন একেকটি সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে ওঠে এখানে-ওখানে।
ধোলাইখালের এ শিল্পটি গাড়ির যন্ত্রাংশের খাতে আমদানির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন প্রকৌশল শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রাজ্জাকও। তিনি বলেন, শক্তিশালী স্থানীয় শিল্প গড়ে তোলার জন্য অবকাঠামো এবং নীতিগত সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন।
একই প্রসঙ্গে মোটর পার্টস ও অটোমোবাইলসহ বিভিন্ন খাতের আন্তর্জাতিক মেলা আয়োজনকারী সংস্থা, সেমস গ্লোবালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রুপ পরিচালক মেহরুন এন ইসলাম বলেন, ‘ধোলাইখালের কারিগরদের অনেক কৃতিত্ব আছে। সেখানে যেসব যন্ত্রাংশ তৈরি হয়, তা বাংলামোটরসহ বিভিন্ন স্থানে বিদেশি পণ্য হিসেবে বিক্রি হয়। কিন্তু ওখানকার ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ব্যবসার লাইসেন্স ছিল না। পরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবকের প্রচেষ্টায় সেখানকার কিছু উদ্যোক্তাকে লাইসেন্স করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাদারভাবে ফরমাল সেক্টর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের যে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার তা নেই। সচেতনতারও অভাব রয়েছে।’