গোপন খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬৮ হাজার কোটি টাকা

রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণ অবলোপন বা গোপন খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে। গত এক বছরে অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। এতে গত জুন শেষে মোট অবলোপকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। ব্যাংক খাতে সাধারণত খেলাপি ঋণের হিসেবে অবলোপন করা ঋণকে হিসাবে ধরা হয় না। এ কারণে সাধারণভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কিছুটা কম দেখানো হয়।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে, অবলোপন করা ঋণও প্রকৃত খেলাপি ঋণ। যেসব ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ, সেসব ঋণকে আর্থিক হিসাবের সুবিধার্থে ব্যাংকের স্থিতিপত্র বা ব্যালান্স শিট থেকে বাদ দেয়া হয়। ফলে ওইসব অনাদায়ি ঋণ লোকচক্ষু ও খেলাপি হিসাবের আড়ালে চলে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুন শেষে পুঞ্জীভূত অবলোপন ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পুঞ্জীভূত অবলোপনকৃত ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা।

তবে এর মধ্যে ১৭ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকার অর্থ আদায়ের পর গত জুন শেষে স্থিতি অবলোপনকৃত ঋণের দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ২৮৬ কোটি টাকায়। ২০২২ সালের জুন শেষে স্থিতি ছিল ৪৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। ওই সময়ে আদায়ের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে যেখানে অবলোপকৃত ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এ সময় এসব ঋণ থেকে আদায় মাত্র ৩৯৩ কোটি টাকা।

জানা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থায় মন্দ মানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বলে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। ঋণ গ্রহীতা পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হন। তবে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হিসাবে তা দেখানো হয় না। যেসব ঋণ নিকট ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা নেই এবং মন্দমানে খেলাপি হওয়ার অন্তত তিন বছর পার হয়েছে ব্যাংকগুলো, কেবল তা অবলোপন করতে পারে। অবলোপন করে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খেলাপি ঋণ আদায় জোরদারের চেয়ে ব্যাংকগুলো মনোযোগ দিচ্ছে অবলোপনের দিকে, যা কোনো ভালো সমাধান নয়। কারণ যে পরিমাণ ‘রাইট অফ’ করা হয়, সে পরিমাণ আদায় হয় না। ঋণ আদায় না করে যদি ‘রাইট অফ’ কৌশল বেছে নেয়া হয়, তাহলে একসময় ব্যাংকের মূলধনও শেষ হয়ে যায়। তাই এটা কোনো ভালো সমাধান নয়।

বিভিন্ন ছাড় দিয়ে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়াল করার সুযোগ দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নানা ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি ঋণ ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়ে গত জুন শেষে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ যতটুকু, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে আরও বেশি। তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেয়ার শর্ত অনুযায়ী ব্যাংক খাতের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ তুলে ধরার জন্য বলা হয়। খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের মধ্যে রয়েছে শ্রেণিকৃত ঋণ, পুনঃতফসিল করা ঋণ, অবলোপন করা ঋণের পুনর্গঠিত অংশ ও আদালতের আদেশে শ্রেণিকৃত নয় এমন ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ সম্পত্তি। আর গত জুনে তা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছেÑখেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪০ কোটি এবং পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ ২ লাখ ৭৮ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা।

জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। আগে মামলা ছাড়া দুই লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত। এখন থেকে অর্থঋণ আদালতে মামলা ছাড়াই পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপন করা যায়। ঋণের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে মামলার খরচ বেশি হয়। এ বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর ছোট ঋণ অবলোপনে এমন সুযোগ দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ঋণ অবলোপনের নতুন শিথিলতা বড় কোনো বিষয় নয়। ছোট ঋণ অবলোপনের জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক খাতের একটা ঝামেলা কমবে।

তিনি আরও বলেন, নতুন সিদ্ধান্তে অবলোপনকৃত ঋণ আদায় বাড়বে না। কারণ ছোটরা কিছু টাকা দিলেও বড়রা টাকা দিচ্ছে না। কিন্তু এসব প্রভাবশালীর থেকে টাকা আদায়ে আইনি কাঠামোয়ও বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ে জবাবদিহি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় সুশাসন ফেরাতে হবে।