Print Date & Time : 5 July 2025 Saturday 9:30 pm

গোপালগঞ্জে কাজ না করে বিল উত্তোলন

অস্ত্র ঠেকিয়ে প্রকৌশলীর কাছ থেকে বিলের স্বাক্ষর আদায়ের অভিযোগ আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে

প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ:
আট বছর আগে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেতু নির্মাণের পর মানুষের ভোগান্তি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আরও বেড়েছে। কাজ শেষ হলেও সেতুর দু’পাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে সেতুতে উঠতে হচ্ছে। সেতু দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার মাঝকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কে খালের ওপর তিনটি সেতু নির্মাণে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। পুরো কাজ শেষ না করে বিল ও জামানতের টাকা উত্তোলন করে নিয়েছেন ঠিকাদার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোপালগঞ্জ জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সোহরাব হোসেন সোহেলের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত দলের সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র।

দুদকের গোপালগঞ্জ জেলা সমন্বিত কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের মাঝকান্দি গ্রামে তিনটি সেতুসহ এইচবিবি রাস্তার নির্মাণ পরিকল্পনা করে জেলা পরিষদ। এ কাজ বাস্তবায়নের জন্য কাশিয়ানীর মেসার্স হাবিব অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর কার্যাদেশ দেয়া হয়। তবে মেসার্স হাবিব অ্যান্ড কোম্পানি ফার্মের নামে কাজটি করেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। প্রতিটি সেতুতে ১২ মিটার করে সংযোগ সড়ক (অ্যাপ্রোচ) নির্মাণ করার কথা থাকলেও না করে টাকা আত্মসাৎ করেছেন ঠিকাদার। কাগজে-কলমে কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে চূড়ান্ত বিল ও জামানতের টাকাও উত্তোলন করেছেন তিনি। তৎকালীন জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী মো. আনিচুর রহমান কাজ বুঝে নিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, জনদুর্ভোগ লাঘবে সরকার প্রায় কোটি টাকা ব্যয় করে সেতু নির্মাণ করলেও দুর্ভোগ কমেনি। বর্তমানে একটি সেতুতে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছেন এলাকাবাসী। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই। অপর দুই সেতুর অ্যাপ্রোচে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ৪০ দিনের কর্মসূচিতে শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে লোকজনের যাতায়াত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

মাইজকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. বেল্লাল খান, আমিরুল ইসলাম ও তাসলিমা বেগম জানান, ভোগান্তি দূর করতে সেতু নির্মাণ করে আরও ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে সেতুতে উঠতে হয়। শিশু ও বৃদ্ধরা মাঝেমধ্যে সিঁড়ি থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে আহত হন। একই গ্রামের বাসিন্দা মোরাদ তালুকদার সেতু থেকে পড়ে গিয়ে আহত হওয়ায় তার বাঁ পা কেটে ফেলতে হয়েছে। দ্রুত সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণের দাবি জানান তারা।

ওড়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান বদরুল আলম বিটুল বলেন, ‘২০১৭ সালে জেলা পরিষদ আমার ইউনিয়নের মাইজকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কে আড়কান্দি এলাকায় তিনটি সেতু নির্মাণ করেছে। কিন্তু সেতুগুলোর অ্যাপ্রোচ না করেই অফিস কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করে দিয়েছে। দীর্ঘ আট বছর ধরে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এলাকাবাসী। আমি এলাকাবাসীর সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০ দিনের কর্মসূচির লোক দিয়ে দুটি সেতুতে মাটি দিয়ে কোনোমতে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তবে একটিতে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে এলাকাবাসী। দ্রুত সেতু তিনটিতে অ্যাপ্রোচ নির্মাণ করা হোক।’
জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন উৎকোচের বিনিময় স্বাক্ষর করার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি বিলে প্রথমে স্বাক্ষর করতে চাইনি। পরে ঠিকাদার গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন।’

দুদকের জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘আমরা সরেজমিনে গিয়েছিলাম। প্রকল্প বাস্তবায়ন অধিদপ্তর জেলা পরিষদে অভিযান চালিয়েছি। অভিযানে দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছি। রেকর্ডপত্র সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে মামলা রুজু করার জন্য সুপারিশ করে কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’