সংবাদ সম্মেলনে আইইএফ

গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা শিল্পঘাতক

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: বাংলাদেশে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আত্মঘাতী পরিকল্পনা বাতিল এবং চলমান গ্যাস সংকট নিরসন শিল্পবান্ধব এবং কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে ইন্ডাস্ট্রি এক্সিকিউটিভ ফোরাম (আইইএফ)। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের নিয়ে নবগঠিত প্ল্যাটফর্ম আইইএফের সদস্যরা কিছু গ্যাস খাত নিয়ে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। শনিবার রাতে রাজধানীর লা ভিঞ্চি হোটেলে অনুষ্ঠিত সভায় দেশের টেক্সটাইল এবং সিরামিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী এবং ব্যবস্থাপকরা বক্তব্য রাখেন।
আইইএফ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এসএইচ ফাহিমের সঞ্চালনায় ‘শিল্পোৎপাদন, সাশ্রয়ী জ্বালানি, কর্মসংস্থান ও টেকসই উন্নয়ন’ শীর্ষক সভায় বক্তব্য রাখেন যমুনা গ্রুপের হুরাইন হাইটেক ফেব্রিকের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাকিম, মিথিলা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মো. সাজেদুর রহমান তালুকদার, প্যারাগন সিরামিকসের সিনিয়র জিএম মোসাহেব কাক্কা ও জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিক্সের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) মো. শফিকুর রহমান।

সভায় বলা হয়, ২০১৯ সাল থেকে দ্রুত এবং ঘন ঘন গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় ২০২২-এর জুনে ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ২০২৪-এর মে মাসে ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি হয়। সে সময় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের প্রতিশ্রুতি, শিল্পের প্রতিষ্ঠানের চাহিদা, পণ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বাধ্যবাদকতা এবং সর্বোপরি অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে শিল্প মালিকরা মূল্যবৃদ্ধি মেনে নেন। যদিও গ্যাসের মূল্য অযাচিতভাবে বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশের অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

আইইএফ সভায় খান কনসালট্যান্সির প্রধান নির্বাহী এবং তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনের সাবেক পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, আমদানিনির্ভর না হয়ে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান এবং উন্নত কারিগরি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে গ্যাসের জন্য নিরাপদ এবং অর্থ ও সময়সাশ্রয়ী পদ্ধতির তাগিদ দেন। অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় সংগঠন আইইএফ বলছে, নতুন শিল্পের জন্য গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন হলে শিল্প ধ্বংস হবে, কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বন্ধ হবে। কারণ নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণ না করলে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারান।

সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশে শিল্প কারখানাগুলোয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহƒত গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিতে বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থার উত্তরণকল্পে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে শিল্পবান্ধব আধুনিক নীতিকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। গ্যাস উত্তোলন, ক্রয় ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ দেয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
আইইএফ বলছে, গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের মতামত অন্তর্ভুক্তিপূর্বক পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বিকল্প এবং পুনঃব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান এবং প্রয়োজনীয় গবেষণার ওপরেও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।

সংগঠনটি বলছে, উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবসায়িক বাস্তবতা বিবেচনা না করে বিভিন্ন অজুহাতে দফায় দফায় গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর আরোপের ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে এবং অনেকগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এতে বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির আগে অবশ্যই শিল্পগ্রাহকদের পরামর্শ ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। আইইএফ মনে করে, রপ্তানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ, প্রয়োজনে গ্রাহকের বর্ধিত চাহিদা পূরণ এবং অতিরিক্ত গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত মূল্য ধার্য না করা জরুরি।

গ্যাস সমস্যা সমাধানে আইইএফ সভায় সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাবনা সরকারের কাছে তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলোÑগ্যাস বিক্রি করে সরকারি মুনাফা না করা, এলএনজি আমদানি থেকে শুল্ককর প্রত্যাহার করা, যে কোনো মূল্যে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করে মজুদ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, শিল্পগ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি বা পুনর্নির্ধারণ বা শুল্ক বা কর আরোপ করা, সর্বাগ্রে যে কোনো মূল্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের চাহিদাকৃত গ্যাসের চাপ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস সন্ধান ও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, প্রতিযোগী দেশসমূহের মতো বাংলাদেশেও নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন ও ভূমি এবং অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগতে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি প্রদান করা এবং গ্যাসের ওপর চাপ কমানোর জন্য শিল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সার্বিক সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা।