গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নির্ভরতার প্রতীক কমিউনিটি ক্লিনিক

সাদেকুর রহমান: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে আমির হামজাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক। সেখানে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন সরকারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা। কয়েক বছর আগেও এলাকার মানুষকে চিকিৎসাসেবা নিতে উপজেলা সদর কিংবা জেলা সদরে আসতে হতো। কমিউনিটি ক্লিনিকের কল্যাণে এখন বাড়ির পাশেই চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন তারা।

নড়াইলের তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করছে জেলার ৯১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকে প্রতি মাসে প্রায় এক লাখ মানুষ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। এসব ক্লিনিককে সরকারের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে ৩২ ধরনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সদর উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা অনিতা বিশ্বাস ও শিপ্রা বিশ্বাস বলেন, ‘আগে আমাদের সামান্য জ্বর হলে হাতুড়ে ডাক্তার বা সদর হাসপাতালে যেতে হতো টাকা ও সময় ব্যয় করে। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকায় আমরা সহজেই সেখান থেকে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ পাচ্ছি।’

কেবল বান্দরবান ও নড়াইল নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এভাবেই চিকিৎসাসেবাকে করেছে সহজ ও কার্যকর। তৃণমূলের সব মানুষের দরজা খোলা এসব ক্লিনিকে। এরই মধ্যে এসব ক্লিনিক ‘গ্রামীণ হাসপাতাল’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রামীণ জনপদে শ্রেণিবৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। সেবার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রচার পাওয়ার সুবাদে এখন চিকিৎসাপ্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একসময় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর মানহীন সেবার জন্য নাক সিটকানো হতো, এখন এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবমর্যাদা তৈরি হয়েছে। যৌক্তিকভাবেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো হয়ে উঠছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নির্ভরতার প্রতীক!

জনমুখী ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা কুড়ানো কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার ফসল। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সুচারুভাবে পারিচালনা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৭৭ কোটি ৫৫ লাখ ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সেবা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে তিন কোটি ৬৯ লাখ জরুরি ও জটিল রোগীকে উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য উচ্চতর চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার করা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে এক কোটি ভিজিটের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকে মানুষ সেবা গ্রহণ করে।

প্রতিদিন প্রতি ক্লিনিকে গড়ে ৪০-৪২ রোগী সেবা গ্রহণ করেন। রোগীদের শতকরা ৮০ ভাগ নারী ও শিশু। সারা দেশে তিন হাজার ৫৮টি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবসংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই ৬৫ হাজার ৯১৯টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। সব ক্লিনিকে মাসে একবার মহিলা ও শিশুদের টিকা দেওয়া হয় এবং প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’ সেøাগানটি আজ বাস্তবে রূপলাভ করেছে। প্রতিটি ক্লিনিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে অনলাইনে রিপোর্টিং করা যায়।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে এমোক্সিসিলিন ২৫০, পেনিসিলিন, কট্রিম, প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, মেট্রোনিডাজল, জিংক, নিয়োমাইসিন অয়নমেন্ট, জেনসন ভায়োলেট, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আয়রন ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইনসহ ২৯ ধরনের ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া পরিকল্পিত জনসংখ্যার লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট তিন ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে এখান থেকে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক পরামর্শও দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ রোগীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। একসময় গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসার জন্য ঝাড়ফুঁক কিংবা হাতুড়ে ডাক্তারের ওপর নির্ভর করতে হতো। সামান্য সর্দিজ্বরেও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো অসহায় হয়ে যেত। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর সে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে।

প্রতিটি ক্লিনিকে একজন করে নিয়োগকৃত প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী (সিএইচসিপি) দায়িত্ব পালন করেন, যিনি শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য সহকারী (এইচএ) ও পরিবারকল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) সপ্তাহে তিন দিন সেবাদানকারীকে সহযোগিতা করেন। স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনার লক্ষ্যে কর্মরত সব নারী সিএইচসিপি’কে পর্যায়ক্রমে ছয় মাসব্যাপী ধাত্রী (কমিউনিটি স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্টÑসিএসবিএ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এক হাজার ৯৩৫ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান, যেমনÑযক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুস্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়াসহ শিশু ও বয়স্কদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি কমাতেও সেবা দেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি, চোখের রোগ এবং দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিকে দেওয়া হয়।

অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিসংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমনÑকনডম, ইসিপি (ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল) ইত্যাদি সার্বক্ষণিকভাবে সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে এসব ক্লিনিকে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর সারা দেশে সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটি আবারও চালু করা হয়।

সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বতর্মানে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩ হাজার ৮৬১টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। আরও এক হাজার ২৯টি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ৮৯০টি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার।

এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আরও মজবুত ভিত্তি দিতে এরই মধ্যে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১৮’ পাস হয়েছে। এ আইনে কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণ, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, গ্র্যাচুইটি ও অবসর ভাতার সুবিধা রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ট্রাস্টে সরকারি থোক বরাদ্দ ও অনুদান থাকবে। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, স্থানীয় সামাজিক সংগঠন বা ব্যক্তিবিশেষ এখানে দান বা অনুদান করতে পারবেন।

কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)-৪ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এ সংশ্লিষ্ট টার্গেট এসডিজি-৩: সব বয়সের সবার জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, যেসব মানুষ এ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা গ্রহণ করছেন, তাদের মধ্যে ৮০-৯৮ শতাংশ মানুষই সেবার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সরকারের নানামুখী উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো স্বাস্থ্যসেবা। আর এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক সরকারের প্রতিশ্রুত স্বাস্থ্যসেবা জনে জনে নিশ্চিত করার মহান লক্ষ্য নিয়ে কার্যকরভাবে অগ্রসর হচ্ছে।

পিআইডি নিবন্ধ