নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধিতে তোড়জোড় শুরু করে সরকার। এতে গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়; যার প্রভাব পড়েছে এর দামে। বাল্ক (পাইকারি) ও গ্রাহক উভয় পর্যায়ে বেশ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম।
সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা আসে ১২ জানুয়ারি। যদিও তা ১ জানুয়ারি থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। এ নিয়ে ১০ বারে বিদ্যুতের গড় দাম বাড়ানো হয়ে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি।
তথ্যমতে, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। আর গত বছর সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৬ এপ্রিল। ওইদিন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যদিও বিদ্যুৎ দাম বৃদ্ধির ঘোষণার দিন (১২ জানুয়ারি) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৩৭৫ মেগাওয়াট।
এদিকে গত ১৩ বছরের বিদ্যুতের দাম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রাহক পর্যায়ে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্য ছিল ৩ টাকা ৭৩ পয়সা। নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা। অর্থাৎ ১৩ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১০০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
নতুন মূল্যহার কার্যকরের ফলে সাধারণ গ্রাহকদের ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম গুনতে হবে ৪ টাকা ৪০ পয়সা। এছাড়া ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের ৬ টাকা ০১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৩০ পয়সা ও ৩০১ থেকে ৪০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হবে। আর ৪০১ থেকে ৬০০ পর্যন্ত ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৪ পয়সা ও ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের প্রতি ইউনিটে ১২ টাকা ০৩ পয়সা হারে বিল গুনতে হবে।
যদিও ২০০৭ সালের মার্চে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত ২ টাকা ৫০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ১৫ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ২৫ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হতো। ২০১০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত দুই টাকা ৬০ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত তিন টাকা ৩০ পয়সা ও ৪০০ ইউনিটের ওপরে পাঁচ টাকা ৬৫ পয়সা করা হয়েছিল।
এ হিসাবে এক দশকে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত গ্রাহকদের বাড়তি বিল গুনতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ১ টাকা ৯০ পয়সা হারে। আর ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের জন্য বাড়তি গুনতে হচ্ছে ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৮৬ পয়সা। অন্যান্য ধাপেও একইভাবে ব্যয় বেড়েছে। যেমন ৬০০ ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের এখন প্রতি ইউনিটে বাড়তি বিল গুনতে হচ্ছে ৬ টাকা ৩৮ পয়সা হারে।
তথ্যমতে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালের মার্চে প্রথম বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় গড় বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাঁড়ায় ৩ টাকা ৯২ পয়সা। পরের বছর (২০১১ সাল) গ্রাহক পর্যায়ে দুই দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ ও ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এতে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪ টাকা ৬৭ পয়সা।
২০১২ সালেও খুচরা বিদ্যুতের দাম দুই দফা বাড়ানো হয়। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে বাড়ে ৭ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে বাড়ে ১৫ শতাংশ। এতে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। এরপর ২০১৪ সালের মার্চে বিদ্যুতের দাম ৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাড়িয়ে করা হয় ৬ টাকা ১৫ পয়সা। আর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়ে হয় ৬ টাকা ৩৩ পয়সা।
এদিকে ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। সে সময় বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৬ টাকা ৮৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে ওইবারই প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণকারী সবগুলো কোম্পানির জন্য অভিন্ন মূল্যহার নির্ধারণ করা হয়। এতে ঢাকার চেয়ে বেশি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের দাম বেশি হারে বাড়ে। এতে মূল্যহার কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা।
সংশোধিত মূল্যহারের ভিত্তিতে ২০২০ সালের গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ১৩ পয়সা। আর সর্বশেষ বিদ্যুতের গড় মূল্যহার ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে গড় মূল্যহার দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৪৯ পয়সা। তবে এবার গণশুনানি উপেক্ষা করে এ ঘোষণা দেয়া হলো। ২০০৭ সালের পর এবারই সরাসরি নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াল বিদ্যুৎ বিভাগ।
যদিও বিদ্যুতের এ দাম বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম. শামসুল আলম। তিনি শেয়ার বিজকে বলছেন, বলা হয়েছিল জরুরি পরিস্থিতিতে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম সরকার বাড়াবে। কিন্তু কোনো জরুরি পরিস্থিতি ছাড়াই এ ধরনের মূল্য বৃদ্ধি সম্পূর্ণ বেআইনি। এছাড়া গত সপ্তাহে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানি আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। শুনানির ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়। এ সময়টুকু অপেক্ষা না করেই দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
উল্লেখ্য, গ্রাহক পর্যায়ের পাশাপাশি ১৩ বছরে বাল্ক মূল্যহার বাড়ানো হয়েছে ৯ বার। এরপরও প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আবার তা ভর্তুকি দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে।