গত দেড় দশকে জ্বালানি খাতে মেলেনি আশানুরূপ সুসংবাদ। একদিকে ফুরিয়ে আসছে মজুত, অন্যদিকে আমদানিনির্ভরতা বাড়ছে গ্যাস খাতে। আবার গত কয়েক বছর দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এরপরও স্বাভাবিক হয়নি জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতি। গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির বিভিন্ন দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছে শেয়ার বিজ। তা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব
ইসমাইল আলী: দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমলেও চাহিদা গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবাসিক ছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্পসহ সব খাতেই বেড়েছে গ্যাসের চাহিদা। এতে ঘাটতি মেটানোর নামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকে ঝুঁকেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের শাসনামলের শেষ ছয় বছরে এ খাতে ব্যয় করা হয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা, যা ঢাকার পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণব্যয়ের সমান। যদিও উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানির দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ঘাড়ে। দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এছাড়া ছয় বছরে ২৬ হাজার ২১৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এ খাতে। বাকি এক লাখ ৩৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা ব্যয় মেটানো হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ছয় বছরে দেশে এলএনাজি আমদানি করা হয়েছে ৪১০ কার্গো। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এসেছে ৩৪৩ কার্গো এলএনজি এবং স্পট মার্কেট থেকে কেনা হয়েছে ৬৭ কার্গো। ছয় বছরে মোট ৫৭ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয়েছে মোট এক লাখ ৬৪ হাজার ২৭৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছর সর্বোচ্চ গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। এ খাতে গত অর্থবছর সর্বোচ্চ ব্যয়ও করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কাতার এনার্জি এবং ২০১৮ সালের ৬ মে ওমানের ওকিউটির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি আমদানির চুক্তি করে। এর মধ্যে কাতার এনার্জির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ ১৫ বছর এবং ওকিউটির সঙ্গে ১০ বছর। কাতারের প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বছরে এক দশমিক ৮ থেকে দুই দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এবং ওমানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বছরে এক-দেড় মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির কথা রয়েছে। এর পাশাপাশি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে স্পট মার্কেটের মাধ্যমেও এলএনজি আমদানি শুরু হয়।
সূত্রমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে শুরু করে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত কাতার এনার্জি থেকে ২৩৩ কার্গো এবং ওকিউটির কাছ থেকে ১১০ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে যথাক্রমে ৩২ দশমিক ৫৫ ও ১৫ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ৯ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪১ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৩৩টি এবং ওমান থেকে আটটি। সে অর্থবছর মোট পাঁচ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর ৬৬ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৩৭টি এবং ওমান থেকে ২৯টি। সে অর্থবছর মোট ৯ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, করোনার প্রভাবে ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। সে সুযোগ ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি শুরু করে বাংলাদেশ। এতে ২০২০-২১ অর্থবছর মোট ৭২ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৪০টি, ওমান থেকে ২১টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ১১টি। সে অর্থবছর মোট ১০ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। তবে বিশ্ববাজারে দাম কমায় দেশেও এলএনজি আমদানি ব্যয় হ্রাস পায়। সে অর্থবছর আমদানি বাড়লেও এ খাতে ব্যয় কমে দাঁড়ায় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ১৬ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৭০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি বাড়লেও ব্যয় কমে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
যদিও পরের বছরই বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়তে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ে এলএনজি আমদানি ব্যয়ে। এতে বাধ্য হয়ে সরকার দেশে গ্যাসের দামও বৃদ্ধি শুরু করে। ২০২১-২২ অর্থবছর মোট ৮২ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৪৪টি, ওমান থেকে ২০টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ১৮টি। সে অর্থবছর মোট ১১ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ৪০ হাজার ৫৬২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ঘনমিটার বা সাড়ে ১৩ শতাংশ গ্যাস আমদানি বাড়লেও ব্যয় বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৪ হাজার ৫৭ কোটি টাকা বা ১৪৬ শতাংশ।
পরের অর্থবছরও আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখীই ছিল। তবে দেশে ডলার সংকট শুরু হওয়ায় সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি কাতার-ওমানের এলএনজি আমদানিও কমানো হয়। এতে প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হলেও দেশে গ্যাসের চরম সংকট দেখা দেয়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি হয়, যা দেশে লোডশেডিং কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। এছাড়া শিল্প উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সার উৎপাদন সে সময় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
২০২২-২৩ অর্থবছর মোট ৬৬ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৩৯টি, ওমান থেকে ১৫টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ১২টি। সে অর্থবছর মোট ৯ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় কমে দাঁড়ায় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ৩৫ হাজার ২৪৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই দশমিক ২২ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি কমে। আর ব্যয় কমে প্রায় পাঁচ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়। মোট ৮৩ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয় গত অর্থবছর, যার মধ্যে কাতার থেকে আসে ৪০টি, ওমান থেকে ১৭টি এবং স্পট মার্কেট থেকে ২৬টি। মোট ১১ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি করা হয়। এতে ব্যয় হয় (রিগ্যাসিফিকেশনসহ) ৪২ হাজার ৬৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ দুই দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস আমদানি বাড়ানো হয়েছে গত অর্থবছর। এতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাত হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, উচ্চ দামের কারণে এলএনজিতে সরকারকে প্রতি বছর বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ভর্তুকি দেয়া হয় দুই হাজার ৫০০ হাজার কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর তিন হাজার ৫০০ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছর দুই হাজার ৪০০ কোটি, ২০২১-২২ অর্থবছর ছয় হাজার কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছর ছয় হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।