ঘুরে দাঁড়াল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

মিজানুর রহমান: ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। তখন দেশটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দেয়। এর ফলে শ্রীলঙ্কার সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তৎকালীন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে শ্রীলঙ্কা তার আমদানি ব্যয়টুকুও মেটাতে পারছিল না। ফলে দেশটিতে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র সংকট দেখা যায়। তবে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা সেই পরিস্থিতি থেকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। আবারও জমে উঠতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি পর্যটন খাত। সেই সঙ্গে দেশটির প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।

অনেকের কাছে প্রশ্ন হলো অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে কীভাবে আবারও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে পুনরুদ্ধার করল। শ্রীলঙ্কা দেশেটিতে যখন অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা চলছিল তখন দেশটির নতুন রাষ্ট্রপতি বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান এসব দেশের জন্য পথপদর্শক হতে পারে।

বৈশ্বিক মহামারি কভিডের অভিঘাতে শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক পতনের সূত্রপাত হয়েছিল। কারণ শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। কভিডকালে দেশটির পর্যটন খাত ধসে পড়ার পাশাপাশি প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যায়। তার ফলে শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালের শুরুর দিকে ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। তখন আবার শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। তারপরে ফলে বিশ্বজুড়ে পণ্য আমদানি ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। একসঙ্গে এতগুলো ধাক্কা শ্রীলঙ্কা একসঙ্গে সামাল দিতে পারেনি।

চরম অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে পড়ে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যান দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসে। তারপর নানা ঘটনার ধারাবাহিকতায় শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরে কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বেইল আউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করেন।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন শ্রীলঙ্কা এখনও পুরোপুরি অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। দেশটির যখন তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবে তখন দেশটির প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ করেছে দেশটি। একটা সময় শ্রীলঙ্কার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি করার মতো কোনো অর্থ ছিল না। ফলে দেশটির বেশির ভাগ দোকানেই ছিল না কোনো পণ্য। যেসব দোকানে সামান্য কিছু পণ্য ছিল সেসব দোকানের সামনে দেখা যায় মানুষের দীর্ঘ সারি। বর্তমানে দেশটির সকল প্রকার পণ্যের দাম বেশি হলেও দেশটি সকল প্রকার পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রাও আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন শ্রীলঙ্কা মাত্র দুটি বিশেষ সুবিধার কারণে মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমত, বেশকিছু সরকারি নীতি আর দ্বিতীয়ত, কিছু প্রকৃতিগত বিষয়। সরকারি নীতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে এবং সেই সঙ্গে দেশটির রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি মূল্যের দাম কমিয়ে জনজীবনকে সহজ করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য ২৩ লাখ অতি দরিদ্র মানুষকে নগদ আর্থিক সহায়তা দিয়েছে সরকার। তবে রণিল বিক্রমাসিংহে সরকার সকল বিষয়ে জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সংস্কার কর্মসূচি অংশ হিসেবে কোনো খাতে কর বাড়ানো এবং কিছু খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো কিছু পদক্ষেপ বেশ অজনপ্রিয় হয়েছে।

গত বছরের চেয়ে বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র থেকে আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৬ শতাংশেরও বেশি। ২০২০ সালে কভিডকালে আয় করেছিল মাত্র ৪৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসেই শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে ৮২৭.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি রেমিট্যান্সও বেড়েছে অনেক বেশি। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। গত বছর শ্রীলঙ্কার ৩ লাখ ১১ হাজারের বেশি দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে পাঠানো হয়। এদের অনেকে ডাক্তার প্যারামেডিকের কিংবা আইটি প্রোফেশনাল সবমিলিয়ে শ্রীলঙ্কা বিদেশে লোক পাঠানোর রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গত এক বছরে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে চালিত বছরের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ।

সেই সঙ্গে কৃষি খাত ভালো করতে শুরু করেছে। বিশেষ করে চা ও রাবার রপ্তানি আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সরকার তাদের অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ আইএমএফের মতো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির সংকট মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাংক বেশ ভালোভাবে এগিয়ে এসেছিল। শ্রীলঙ্কায় চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্য থেকে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরুরি প্রয়োজনের খাতে সরিয়ে নেই, যা ওষুধ জ্বালানি এবং সারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে ব্যবহার করা হয়।

এর বাইরে দেশটির বাজেট ঘাটতি পূরণ করতে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে সংকটকালীন মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি তথ্য মতে জানা যায়, দেশটির বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার ৬.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও শ্রীলঙ্কার জিডিপি কিছুটা কমতির দিকে থাকবে। তবে ২০২৪ সাল থেকে দেশটির জিডিপি আবারও স্বাভাবিক হবে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষের দিকেই তাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক হবে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেও বেশি। কোনো কোনো সংস্থার মতে এ ঋণের পরিমাণ ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি হতে পারে। তার মধ্যে চীন, জাপান, ভারতকেই পরিশোধ করতে হবে ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঋণ।

মোট ঋণের মধ্যে আবার ২৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ কর্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। শ্রীলঙ্কা যখন ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করবে তখন বোঝা যাবে তাদের অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারল। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে কারেন্সি সোয়াপ পদ্ধতিতে বাংলাদেশের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা এক বছরের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের ৫০ মিলিয়ন ডলার সম্প্রতি সময়ে পরিশোধ করেছে। সেই সঙ্গে খুব শিগগিরই আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করার কথা রয়েছে।

দেশটির সংস্কার কার্যক্রম চালাতে গিয়েও সরকারকে বেশকিছু সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চলতি বছর সব মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ শতাংশ করে কমিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া দেশটির সাময়িক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও কমিয়ে অর্ধেকে আনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের নিয়মিত বেতনভাতা দিতেও সরকারের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি খরচ কমানোর জন্য শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস, শ্রীলঙ্কান টেলিকম এবং ইস্যুবেন্স কোম্পানিগুলোকে বেসরকারি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন সংগঠন সরকারের এই সব পরিকল্পনার বিরোধিতা করে সরকারের এসব পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভর্তুকি কমানো বা বাদ দেয়ার কারণে মানুষের ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যেমন শুধু বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। যার ফলে নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। সব বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে এবং দেশটিকে আবারও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে শ্রীলঙ্কাকে হয়তো আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে শ্রীলঙ্কার এ অর্থনৈতিক উত্থান হতে পারে অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়