Print Date & Time : 4 July 2025 Friday 10:48 pm

ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া টাঙ্গাইলের তাঁতিরা!

এনায়েত করিম বিজয়, টাঙ্গাইল: করোনা ও ওমিক্রনের প্রভাবে ধীর্ঘদিন স্থবির হয়ে পড়েছিল টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প। এই সময়ে অসংখ্য তাঁত বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে যায় তাঁতশ্রমিকরা। তবে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ঈদকে সামনে রেখে হঠাৎ কর্মমূখর হয়ে উঠেছে তাঁতপল্লী। শাড়ি উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তাঁতিরা। ইতোমধ্যে দীর্ঘদিন ঘরে আটকে থাকা শাড়িগুলো বিক্রি শেষ হয়েছে।  

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, করোনার প্রথম ঢেউয়ে লকডাউনে তাঁতে কাপড় তৈরিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের কবলে পড়ে ওই সময় অসংখ্য তাঁত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। ফলে শ্রমিকরা তাদের পরিবার নিয়ে পড়েন চরম বিপাকে। বেঁচে থাকার তাগিতে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগ দেয় অসংখ্য শ্রমিক। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রমজানের আগ মূহুর্ত থেকে কিছু কিছু তাঁত খুলতে শুরু করেছে তাঁতীরা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তাঁতপল্লীতে পাইকাররা আসা শুরু করেছে। শাড়ির চাহিদা পূরণ করতে পুরো তাঁতপল্লী এখন কর্মমূখর। যেন ঈদ আনন্দ শুরু হয়ে গেছে। ঈদকে সামনে রেখে টাঙ্গাইল শাড়িতে যোগ হয়েছে বাহারি রঙ আর নতুন সব কারুকাজ।

এদিকে, তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লায় এ দুইটি বেসিক সেন্টারের নিয়ন্ত্রণে ৩০ হাজারের উপরে তাঁত রয়েছে। এখনও ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

টাঙ্গাইল সদরের বাজিদপুর, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডী, নলশোধা, ধুলটিয়া, কালিহাতীর বল্লা রামপুরের তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ারের চন্ডী-পাথরাইল মূলত তাঁতপল্লী হিসেবে পরিচিত। এখানকার উৎপাদিত তাঁতের শাড়ি সারাদেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও রপ্তানি হয়ে থাকে। রাতভর কাজ করেও তাঁতশ্রমিকদের ক্লান্তি নেই। উৎপাদন যত বেশী হবে, সাপ্তাহিক বিল ততো বেশি পাবে। সুঁতা রং করা থেকে শুরু করে শাড়ি বিক্রি করা পর্যন্ত কাজের ধাপে-ধাপে পরিবারের সব বয়সের সদস্যরা জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে উৎপাদন ও বাজার উভয়ই ভাল যাচ্ছে। ঈদকে কেন্দ্র করে বাজারে নেমেছে নতুন কারুকাজের শাড়ি। ভিন্ন বুটি আর নতুন নকশায় তৈরি এই শাড়ি শুধু ঈদ উৎসবের জন্য।

পাথরাইল এলাকার তাঁতশ্রমিক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘জামদানি শাড়ি তৈরির মজুরি আগে ১২০০ টাকা ছিল। এখন ৯০০টাকা দিচ্ছে। প্রতি কাপড়ে ৩০০ টাকা কম। কিন্তু কি আর কবরো সংসার তো চালাতে হবে। এজন্য সহ্য করে কম মজুরিতেই শাড়ি তৈরি করতে হচ্ছে।’

আব্দুল বাছেদ বলেন, ‘আগে শাড়ি তৈরির মজুরি ছিল ১২০০ টাকা। আর এখন ৮০০ টাকা দিচ্ছে। প্রতি কাপড়ে ৩-৪শ’ টাকা কম দিচ্ছে। মহোজনে ঠিক মতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না। এভাবেই কাজ করছি।’

টাঙ্গাইলের সব চেয়ে বড় শাড়ির হাটঘুরে দেখা যায়, তাঁতিরা তাদের উৎপাদিত কাপড় নিয়ে প্রতিযোগীতায় নেমেছেন। স্থানীয় ও দূর থেকে আসা অধিকাংশ ক্রেতাদের চাহিদা এখন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করতে অনেকটাই উপযোগি টাঙ্গাইল শাড়ি। মূল্যসীমা হাতের নাগালে রয়েছে সুঁতি শাড়ি। যার খুচরা মূল্য ৩ থেকে ৪শ’ টাকার মধ্য। এছাড়া সিল্ক, সপসিল্ক, রেশন ও দুতারের মধ্যেও রয়েছে উন্নতমানের টাঙ্গাইল শাড়ি। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলের জামদানি শাড়িতে রয়েছে বাড়তি আকর্ষণ।

টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও দেশের বাইরে থেকেও পাইকাররা আসছে শাড়ি কিনতে। এখন করটিয়া হাটে শাড়ির চাহিদা রয়েছে ভালোই। দীর্ঘদিন পর বেচা-কেনা ভালো হচ্ছে।’

শাড়ি ব্যবসায়ী উত্তম কুমার বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন হাটে তেমনটা কাপড় বিক্রি হয়নি। এখন সব স্বাভাবিক থাকায় হাটে কাপড়ের চাহিদা রয়েছে। এজন্য তাঁতিরাও শাড়ি তৈরি করছেন। হাটে বেচা-কেনাও ভালো হচ্ছে।’

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত চন্ডী-পাথরাইল শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর আবার তাঁতপল্লীতে খটখট শব্দ শুরু হয়েছে। এখন জেলায় ৪০ শতাংশ তাঁত চলছে। আর এখনও শ্রমিক ও টাকার অভাবে ৬০ শতাংশ তাঁত বন্ধ রয়েছে। এই ৪০ শতাংশ তাঁত দিয়েই তাঁতিরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ঘরে আটকে থাকা কাপড়গুলো ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার ঈদকে সামনে রেখে কাপড় তৈরির কাজ চলছে।’

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইলের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যারা এই তাঁত পেশাটা ছেড়ে দিয়েছেন। তারা যেন আবার ফিরে আসতে পারে সেজন্য তাঁত বোর্ড বড় রকমের ঋণ সুবিধা দিতে কাজ করছে।’