নজরুল ইসলাম: পদ ডিসি অফিসের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখার সার্ভেয়ার। মেয়েকে পড়ান ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজে। রাজধানীতে কিনেছেন ফ্ল্যাট, প্লট ও দোকান। মেয়ের নামেও কিনেছেন জমি। ভাইয়ের নামে কেনা ফ্ল্যাট পরে হেবা দলিলে নিজের নামে রেজিস্ট্রি করেছেন। শাশুড়ি ও শ্যালিকার নামে ফ্ল্যাট ও দোকান কিনে পরে ওই ফ্ল্যাট ও দোকান হেবা দলিলে স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। ‘ঘুষের’ টাকায় এভাবেই গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এছাড়া নিজের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ বৈধ করতে স্ত্রীর আয়কর নথিতে পেশা হিসেবে ব্যবসা করার মিথ্যা তথ্যও দিয়েছেন। এসবই করেছেন সার্ভেয়ার আসাদুজ্জামান (৪৮)। সব মিলিয়ে মা ও বোনের কাছ থেকে ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার সম্পদ দান বা উপহার হিসেবে পেয়েছেন তার স্ত্রী কামরুন নাহার! তাদের দুজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া মামলা দুটি দায়ের করেছেন।
আসাদুজ্জামান ১৯৯৬ সালের ৭ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সার্ভেয়ার পদে যোগ দেন। পরে ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখায় যোগ দেন। ২০১৯ সালের ৩ জুলাই তিনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন। তার বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায়।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, আসাদুজ্জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
দুদকের মামলা ও সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমার ২৭৩ জন সার্ভেয়ার। দেখে বলতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (এলএ) সঙ্গে কথা বলুন।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) শাহনাজ সুলতানার মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বার্তা দেয়া হলেও কোনো উত্তর দেননি।
আসাদুজ্জামান তার ভাই নুরুল ইসলামের নামে ৪২ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট কিনে মাত্র ২ মাস পরেই নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে অবৈধভাবে উপার্জিত ফ্ল্যাটের মূল্য গোপন করেছেন। তিনি তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৬০৩৬ নম্বর দলিলে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ফ্ল্যাটটি কিনে ৬৭২ নম্বর দলিলে ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে নিজের নামে হেবা দলিলে রেজিস্ট্রি করে নেন।
অনুসন্ধানকালে তার নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলে মোট সম্পদ পাওয়া যায় ৭১ লাখ ৮২ হাজার ১৩১ টাকার। পারিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ২৭৩ টাকার। পারিবারিক ব্যয়সহ অর্জিত মোট সম্পদের মূল্য
৮৭ লাখ ৪৭ হাজার ৪০৪ টাকা। গ্রহণযোগ্য আয়ের পরিমাণ পাওয়া যায় ৩৪ লাখ ১৮ হাজার ২৩০ টাকা। এক্ষেত্রে তার নামে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া যায় ৫৩ লাখ ২৯ হাজার ১৭৪ টাকা। এফডিআর হিসাবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে মাত্র ৬ বছরে মোট ২ কোটি ৩৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯১৫ টাকা জমা ও উত্তোলনের তথ্য পাওযা যায়। অ্যাকাউন্টগুলোতে লেনদেন করা অর্থের উৎস ও বর্তমান অবস্থান বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে পারেননি।
কামরুন নাহারের নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৭০ লাখ ২৮ হাজার টাকার। দায়-দেনা পাওয়া যায় ২ লাখ টাকার। পারিবারিক ব্যয় ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকার। দায়-দেনা বাদে তার মোট সম্পদ পাওয়া যায় ৬৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা। পারিবারিক ব্যয়সহ অর্জিত মোট সম্পদের মূল্য পাওয়া যায় ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। কামরুন নাহারের ভোগ দখলে থাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ পাওয়া ৬০ লাখ ৯৮ হাজার টাকার। অর্থাৎ কামরুন নাহার তার স্বামী আসাদুজ্জামানের অবৈধ উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত এই সম্পদ ভোগ দখলে রেখেছেন। কামরুন নাহারের নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ঢাকার শান্তিনগর শাখায় দুটি এফডিআর হিসাবে ৬ বছরে মোট ৪ কোটি ৫০ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৯ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়।
আসাদুজ্জামানের নামে ওয়ারিশসূত্রে পাওয়া পটুয়াখালীর বাউফলের রামনগর মৌজায় ৩০ শতাংশ নাল জমি, রাজনগর মৌজায় ৩৩.৫০ শতাংশ নাল জমি, কায়না মৌজায় ৩০ শতাংশ নাল জমি ও সাবুপুরা মৌজায় ২০ শতাংশ নাল জমি। বাউফলের রামানগর মৌজায় ৪১ শতাংশ নাল জমি। ভাইয়ের থেকে হেবা দলিলে পাওয়া ঢাকার কাঁঠালবাগানের কালভার্ট রোডের ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকায় ১১/৮/ডি হোল্ডিং নম্বর ফ্ল্যাট। স্ত্রীর নামে আমমোক্তার দলিলে রূপগঞ্জের পূর্বাচল উপশহরে ৪ নম্বর সেক্টরে ৩১১/বি রোডে ৪ নম্বর প্লটে ৩ কাঠা প্লট। ভায়রা থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের নামে ঢাকার বড় মগবাজার মৌজায় ০.০০৫০ একর নালা জমি। ভায়রা থেকে ঋণ নিয়ে ও স্বর্ণ বিক্রি করে যাত্রাবাড়ীর ধবলপুরে ০.০৪ একর পুকুর বর্তমানে ৫ শতাংশ জমি। মেয়ের নামে রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ মৌজায় ৮২৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে ০.০৫৩৩ একর ভিটা জমি ও নিজের নামে পিতলগঞ্জ মৌজায় ০.০৯ একর নাল জমি। ফতুল্লার কুতুবপুর মৌজায় ০.০৩ একর নাল জমি, বাস্তবে জমির পরিমাণ .০৬ একর বা ৬ শতাংশ। এই জমিটির মূল্য ৯৮ হাজার টাকা প্রদর্শন করা হয়েছে, কিন্তু; অনুসন্ধানে এর মূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এখানে ৮২ হাজার টাকা গোপন করা হয়েছে। বরিশালের কোতোয়ালির রূপাতলি মৌজায় ০.০৫ একর নাল জমি।
আসাদুজ্জামানকে তার বড় ভাই নুরুল ইসলামের নামে ঢাকার কাঁঠালবাগানের কালভার্ট রোডে ১৫২০ বর্গফুটের ৪২ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট হেবা দলিলে দান করেছেন। এর বিনিময়ে তিনি তার পৈতৃক সম্পত্তির কিছু জমি হেবাদানকারী ভাইকে সাফ-কবলা দলিলে রেজিস্ট্রি করে দেবেন বলে একটি অঙ্গীকারনামা করেন। তবে অনুসন্ধানকালে অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী আসাদুজ্জামান তার ভাইকে জমি রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন মর্মে কোনো দলিল বা রেকর্ডপত্র সরবরাহ করেতে পারেননি। ফ্ল্যাট দানের বিষয়ে নুরুল ইসলামকে বক্তব্য দিতে নোটিশ জারি করা হলেও তিনি হাজির হননি। এছাড়া সংশ্লিষ্ট থানার ওসির মাধ্যমে নোটিশ জারি করা হলেও তিনি হাজির হননি। ফ্ল্যাটটি কেনার মতো তার ভাইয়ের কোনো আয়ের উৎসও ছিল না। এতেও প্রতীয়মান হয়, আসাদুজ্জামান ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ বৈধ করার অসৎ উদ্দেশ্যে তার ভাইয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনে পরে তার নামে হেবা দলিলে রেজিস্ট্রি করেছেন।
আসাদুজ্জামান তার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভায়রার নামে ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ২৪ লাখ ৭৪ হাজার ৭২৮ টাকা ঋণ গ্রহণের তথ্য দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন তারিখে আসাদুজ্জামানের নামে ওই টাকা পাঠানো হয়েছে। প্রায় ১৩ বছর পর ২০১৯ সালে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ওই টাকা ঋণ হিসাবে দেখানোর বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। ১৩ বছরেও ওই ঋণ কেন পরিশোধ করা হয়নি; সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য তিনি দেননি। তাছাড়া ঋণদানকারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তারও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। সম্পদ বিবরণীতে প্রদর্শিত ২৪ লাখ ৪ হাজার ৭২৮ টাকা দায়-দেনার তথ্য সঠিক নয় মর্মে অনুসন্ধানকালে প্রতীয়মান হয়।
কামরুন নাহারেও নামে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পটুয়াখালীর বাউফলের হোসনাবাদ মৌজায় ৮২ শতাংশ নাল জমি ও বিলবিলাস মৌজায় ৬৫ শতক ফসলি জমি। মা ফাতেমা বেগম থেকে হেবা দলিলে পাওয়া ঢাকার কাঁঠাল বাগানের কালভার্ট রোডে ১২৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। বড় বোন থেকে হেবা দলিলে পাওয়া কাঁঠালবাগানে নাসির কমপ্লেক্স ভবনের প্রথম তলায় ৩ ও ৯ নম্বর দোকান। ভাষানটেকের জোয়ার সাহারা মৌজায় ০.০০৩৪ অযুতাংশ বোরো জমি। সাভারের বলিয়ারপুর মৌজায় দুটি দলিলে ১৫ শতাংশ বোরো জমি। সাভারের বাড়ইগ্রামে ০.০৪৭৫ অযুতাংশ জমি। বিলমারিয়া মৌজায় ০.০৪৫০ একর বোরো জমি। বিলবাগিল মৌজায় ০.০৫ একর বোরো জমি। যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ০.০১ একর পুকুর বর্তমানে বাড়ি ও ফতুল্লার কুতুবপুর মৌজায় ৮২৪ একর নাল জমি রয়েছে।
কামরুন নাহারকে তার মা ফাতেমা বেগম ঢাকার কাঁঠালবাগানের কালভার্ট রোডে হেবা দলিলে দান করা ১২৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দলিল মূল্য ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ফাতেমা বেগমের কাছে ওই ফø্যাট কেনার মতো কোনো আয়ের উৎস ছিল না। ফাতেমা বেগমের নামে আয়কর নথিও নেই। এছাড়া তিনি তার অন্য কোনো ছেলে-মেয়ের নামে অর্থ-সম্পদ দান না করে শুধু ছোট মেয়ে কামরুন নাহারকে ফ্ল্যাট দানের বিষয়টিও রহস্যজনক। স্বামী আসাদুজ্জামানের ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় শাশুড়ির নামে তেজগাঁও সাব রেজিস্ট্রি অফিসের ১৮১৫ নম্বর দলিলে ২০১৭ সালের ৭ মে ফ্ল্যাটটি কিনে আট দিন পর ১৯৩৯ নম্বর দলিলে ১৫ মে কামরুন নাহারের নামে হেবা দলিলে রেজিস্ট্রি করে নেন। ফ্ল্যাট কেনার ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার বৈধ আয়ের উৎসও পাওয়া যায়নি।
বোন নাজমুন নাহারের নামে ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১১১৪ নম্বর দলিলে ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ ৯ লাখ ৩০ হাজার টাকায় ঢাকার কাঁঠালবাগানে নাসির কমপ্লেক্স ভবনের প্রথম তলায় ৩ ও ৯ নম্বর দোকান কিনে ৯ মাস পর ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৪৬৮৬ নম্বর দলিলে ১৩ ডিসেম্বর কামরুন নাহারের নামে হেবা দলিলে রেজিস্ট্রি করা হয়। নাজমুন নাহার তার কোনো ভাই-বোনের নামে অর্থ-সম্পদ দান না করে শুধু ছোট বোন কামরুন নাহারকে দান করার বিষয়টিও রহস্যজনক। নাজমুন নাহার ঢাকা মেট্রো-গ-২৬-১১০৮ নম্বরের একটি প্রাইভেট কারও বোন কামরুন নাহারকে দান করেছেন; যার মূল্য ৫ লাখ টাকা ঘোষণা দিলেও প্রকৃতমূল্য আরও বেশি হবে। এতে প্রতীয়মান হয়, স্বামী আসাদুজ্জামানের ঘুষ-দুর্নীতির টাকা বৈধ করতে বোন নাজমুন নাহারের নামে সম্পদ কিনে পরে নিজের নামে হেবা দলিলে রেজিস্ট্রি করে নেন কামরুন নাহার। সব মিলিয়ে তিনি মা ও বোনের কাছ থেকে ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার সম্পদ দান বা উপহার হিসেবে পেয়েছেন! দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও মামলার এজাহার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সার্ভেয়ার আসাদুজ্জামানের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি এখন ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখায় নেই। এরপর তিনি কল কেটে দেন।’ তারপর কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে ফোন বন্ধ করে দেন।