নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: কক্সবাজারের মহেশখালীতে অবস্থিত এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। দেশের অন্যান্য এলাকায় শীতের কারণে গ্যাসের চাপ কম ছিল। গতকাল শুক্রবার দুপুরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা এবং কোম্পানিসমূহ সার্বক্ষণিক তদারক করছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অতি দ্রুত মেরামতের লক্ষ্যে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। গ্রাহকদের সাময়িক অসুবিধার জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করছে বলেও জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে একপ্রকার খাবার সংকটেই পড়ে গেছে চট্টগ্রামের মানুষ। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ তদারকি করে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড। গ্যাসের সরবরাহের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করে আমদানিকৃত এলএনজির ওপর।
কর্ণফুলী গ্যাসের কর্মকর্তারা জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরের তলদেশের সঞ্চালন পাইপলাইনের (কনভার্টারের) মাধ্যমে এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ হয়। দুটি কনভার্টারের মধ্যে একটিতে গত নভেম্বর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছিল। একটি পাইপলাইন দিয়েই এতদিন সরবরাহ চলছিল। গত বৃহস্পতিবার রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া কনভার্টারটি কমিশনিং করা হয়েছে। পাশাপাশি অপর কনভার্টারটি রি-কমিশনিং করা হয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। কিন্তু মধ্যরাত থেকে নতুন কমিশনিং হওয়া কনভার্টারের জেনারেটর বিকল হয়ে গেছে। এজন্য পুরোপুরি গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর বলেন, রক্ষাবেক্ষণ হওয়া কনভার্টারটি কমিশনিং করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যটি রি-কমিশনিং করে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণ হওয়া কমিশনিং করা কনর্ভাটারটিতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এজন্য গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
গ্যাস সরবরাহ কখন শুরু হতে পারেÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন বলা যাচ্ছে না। কাজ চলছে। দু-এক দিনও লাগতে পারে।’
শুক্রবার মধ্যরাত থেকে চট্টগ্রাম গ্যাসবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় সার কারখানা কাফকো ও সিইউএফএল, শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ গ্যাসনির্ভর সব শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস নেই ৬৮টি সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনেও। এছাড়া চট্টগ্রামে ইস্পাত, সিমেন্ট, শিপ ব্রেকিং, ঢেউটিন, গার্মেন্টের মতো শিল্প খাতে কয়েক হাজার বাণিজ্যিক এবং ছয় লাখেরও বেশি আবাসিক গ্রাহকের সংযোগ গ্যাসবিচ্ছিন্ন।
চট্টগ্রামে আগে গ্যাস সংকট হলে সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাস আনা হতো আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপলাইন দিয়ে। কিন্তু এলএনজি আমদানি শুরু করার পর আশুগঞ্জ বাখরাবাদ পাইপলাইনকে বাল্ব লাগিয়ে ওয়ান-ওয়ে করে ফেলা হয়। ফলে চট্টগ্রাম থেকে গ্যাস শুধু নেয়া যায়, আনা যায় না।
গ্যাস সংকট থাকায় সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। ছুটির দিনে কর্মজীবী মানুষেরা বাসায় থাকেন, ফলে রান্না বন্ধ থাকায় খাবার সংকটে পড়তে হয়েছে তাদের। সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন সড়কে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয় মানুষকে ভিড় করতে দেখা গেছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সকালের নাস্তা বা দুপুরের খাবার সংগ্রহ করতে দেখা গেছে তাদের। সড়কের টং দোকানগুলোয়ও ছিল ভিড়। ছুটির দিনে অনেক বেকারি বন্ধ থাকায় পাউরুটি পাওয়া যাচ্ছিল না দোকানগুলোয়। এছাড়া বাড়তি দামে খাবার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। দোকানিরা সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে রান্না করার অজুহাতে খাবারের বেশি দাম আদায় করছেন বলে অভিযোগ করেন অনেকে।
তবে দুটি পাইপলাইনের মধ্যে একটি দিয়ে সরবরাহ করায় গত নভেম্বর থেকে গ্যাসের চাপ স্বাভাবিকের তুলনায় কম ছিল চট্টগ্রামে। এছাড়া শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলসহ বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানার মালিকেরা উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচ। দুটি পাইপলাইন দিয়ে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে আগামী মার্চ বা এপ্রিলের আগে গ্যাস-পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
আরপিজিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. শাহ আলম বলেন, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ থাকলেও জানুয়ারিতে এই সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এখন গ্যাসের সরবরাহ দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে। এলএনজি আমদানি করতে হয় স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে। ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কম। কিন্তু এখন এলএনজি টার্মিনালে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তারা।