চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারে ফাটল, ফের দুর্ঘটনার শঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের যানজট নিরসনে ২০১০ সালে এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের (বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার) ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। চাল লেনের এক হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৪ মিটার প্রস্থের ফ্লাইওভারটি নির্মাণকাজ শেষে ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু চার দফা ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি টাকায় শেষ হওয়া ফ্লাইওভারটিতে আগে দুবার দুর্ঘটনায় ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছিল। সর্বশেষ ২৫ অক্টোবর ফ্লাইওভারের দুটি পিলারে বড় ধরনের ফাটল শনাক্ত হওয়ায় ফের দুর্ঘটনার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে দুর্ঘটনা এড়াতে ফ্লাইওভারের মোহরা অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

এর আগে অর্থাৎ উদ্বোধনের আগে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমটি ২০১২ সালের ২৯ জুন বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ২১ ও ২২ নম্বর পিলারের মাঝের একটি গার্ডার ভেঙে পড়ে। ওইদিন শুক্রবার জুমার নামাজ চলাকালে এ দুর্ঘটনা ঘটায় এক রিকশাচালক আহত হলেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ওই ঘটনায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত করে কাজের দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতাকে দায়ী করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পাঁচ দফা সুপারিশ করে। কিন্তু এসব সুপারিশ আমলে নেয়নি সিডিএ কর্তৃপক্ষ। ফলে সুপারিশ না মেনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ চালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর একই বছর ২১ নভেম্বর এ ফ্লাইওভারের লোহার অ্যাঙ্গেল ভেঙে এক স্কুলশিক্ষিকার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এ ফ্লাইওভারে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে ঘটনাস্থলে ১৭ জন নিহত ও প্রায় ৮০ জন আহত হন। সর্বশেষ ২৫ অক্টোবর বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুটি পিলারে বড় ধরনের ফাটল শনাক্ত হয়েছে। বহদ্দারহাট মদিনা হোটেলের সামনে র‌্যাম্প ও ফ্লাইওভারের সংযোগস্থলের কিছু নাট ঢিলে হয়ে গেছে। এর প্রভাবে র‌্যাম্প হালকা দেবে যাওয়ায় ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে ফাটল শনাক্ত করার পর দুর্ঘটনা এড়াতে ফ্লাইওভারের মোহরা অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিল সামস্ শেয়ার বিজকে বলেন, আপনারা যেমন বলছেন, তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। সামান্য ফাটল হতে পারে। আমি এখন ঢাকায় মিটিংয়ে এসেছি। চট্টগ্রাম গিয়ে একটা তদন্ত কমিটি করে দেব। তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ দেবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

মূল ডিজাইনের বাইরে র‌্যাম্প করার শুরু থেকে নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা নির্মাণকাজে পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা বলে আসছিলেন। মূলত ফ্লাইওভারটির লুপ চালু হওয়ার প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালে সিডিএ ফ্লাইওভারটিতে ৩০০ মিটারের র‌্যাম্প নির্মাণ করে। ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর ৩২৬ মিটার দীর্ঘ ও ছয় দশমিক সাত মিটার চওড়া র‌্যাম্পটি উদ্বোধন করা হয়।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের মার্চে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মীর আক্তার-পারিশা (জেভি) কনস্ট্রাকশন। মীর আকতার প্রধান অংশীদার হলেও মূল কাজ করে পারিশা। তারপর ফ্লাইওভার ট্র্যাজেডির দুই মাস ১৯ দিন পর সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাকি কাজ শেষ করা হয়। সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করে সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্ক অরগানাইজেশন (এসডবিউও)।

প্রথমে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯১ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ১০৬ কোটি টাকা করা হয়। ফের সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ১২০ কোটি টাকা করা হয়। তারপর আরেক দফা ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি টাকায় নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এক হাজার ৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্যরে ফ্লাইওভারটির প্রস্থ ১৪ মিটার। চার লেনের বহদ্দারহাট এ ফ্লাইওভারের দুই পিলারের দূরত্ব ১৩০ ফুট।

এদিকে ২৬ অক্টোবর সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র এম রেজাউল করিম বলেন, ‘ফ্লাইওভারে যেভাবে ফাটল দেখা দিয়েছে, আমি নিজেই অবাক হয়েছি। আমি তো প্রকৌশলী নই, প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে, নির্মাণজনিত ত্রুটির কারণে এ ফাটল দেখা দিয়েছে। ফাটলের পর থেকে র‌্যাম্পের ওপর এবং নিচের সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেহেতু এ ফ্লাইওভার সিডিএ নির্মাণ করেছে, তাই তাদের চিঠি দেয়া হচ্ছে। তারা তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবে। প্রয়োজনে আমরা তাদের সহযোগিতা করব।’