সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: জাতীয় রাজস্বের সিংহভাগ আহরণ হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে। ফলে দেশের অন্যান্য শুল্ক স্টেশনের তুলনায় চট্টগ্রাম কাস্টমসে শুল্কায়নযোগ্য চালানের সংখ্যা বেশি। এতে প্রতিদিন শুল্কায়ন পর্যায়ে এইচএস কোড ও মূল্য পরিবর্তনসহ নানা কারণে মামলা হয়; যা নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। তাই বছরের পর বছর ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চালু হয় এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) পদ্ধতি। কিন্তু ২০১২ সালে চালু কার্যক্রমটি ২০১৬ সালে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রায় তিন বছর বন্ধের পর ২০১৯ সালের প্রথম দিকে ফের চালু হয়। কিন্তু এবার ১৮টি মামলা নিষ্পত্তির পর কার্যক্রমটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ৮ হাজারের বেশি মামলা নিষ্পতির জন্য ঝুলে থাকে। এতে সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আটকা পড়ে আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এডিআরের মাধ্যমে এসব মামলা নিষ্পত্তি হলে কাস্টমস ও আমদানিকারক উভয়ই লাভবান হবে। এতে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকা মামলার জটও কমবে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সাল থেকে প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে ও ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী টিকে গ্রুপের ১৮ মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে একবার এডিআর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ওই সময় টিকে গ্রুপের ১৩ থেকে ১৪ বছরের পুরোনো ২০ মামলা এডিআরে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলে, ২০১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য ও নির্বাচিত সহায়তাকারী মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এরপর ২৪ ডিসেম্বর আরও সাতটি মামাল নিষ্পত্তি করেন এনবিআরের নির্বাচিত সহায়তাকারী আবদুল মান্নান পাটোয়ারী ও ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী। তারপর ২০১৯ সালে ৬ জানুয়ারি আটটি ও ৭ জানুয়ারি দুটি মামলা নিষ্পত্তি করে কাস্টম। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে উপস্থিত ছিলেন এনবিআরের নির্বাচিত সহায়তাকারী সাহাবউদ্দিন ও আলী আহমদ।
জানা যায়, উচ্চ আদালত ও কাস্টমসের আপিল ট্রাইব্যুনালে দীর্ঘদিন থেকে নিষ্পন্ন না হওয়া রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য সরকার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিভিন্ন সংস্থার তরফে তদন্ত প্রক্রিয়ার কারণে গত কয়েক বছর এক ধরনের থমকে দাঁড়ায় কার্যক্রমটি। মূলত এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া কিছু মামলা ২০১৬ সালে দুদক পুনরায় তলব করায় সংশ্লিষ্টরা বিব্রত বোধ করেন। এতে এডিআরে মামলা নিতে আগ্রহ হারায় আমদানিকারক, ফেসিলিটেটর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। তবে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই। এখন এডিআরে মামলা না আসার পেছনে ব্যবসায়ীরা কাস্টমসকে দায়ী করছেন। অন্যদিকে কাস্টমস ব্যবসায়ীদের দায়ী করছে।
কাস্টম কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা মামলা নিষ্পত্তির জন্য এডিআরে না আনলে আমাদের করার কিছু নেই। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাস্টমসের ছাড় দেয়ার মানসিকতা নেই; ফলে এডিআরে নিষ্পত্তির জন্য আনলেও আমাদের লাভ হয় না, উল্টো এডিআরে আনতে যে টাকা খরচ হয়, সেটাই গচ্চা যায়। ফলে আপিল বিভাগে ১৩৬টি, হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ হাজার ৯৮৬টি, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে এক হাজার ৭৫৯টি এবং কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট (আপিল) কমিশনারেটে ১৪২টিসহ আট হাজারের বেশি অনিষ্পন্ন মামলা রয়ে গেছে। এতে সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আটকা পড়ে আছে। তবে উভয় পক্ষই বলছে, বছরের পর বছর মামলায় না থেকে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে গেলে সব পক্ষই লাভবান হবে।
জানা যায়, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান একাধিকবার এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিলেও গত তিন বছরে কোনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। মূলত এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে কাস্টমস ও আমদানিকারক কোনো পক্ষই আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করতে হলে দুই পক্ষকে ছাড় দিয়ে হয়। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে কোনো এক পক্ষের ছাড় দেয়ার মানসিকতা না থাকলে এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হয় না। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা বনানীর আমদানিকারক সুজারা করপোরেশন ও ইসলামপুরের এসএইচ এন্টারপ্রাইজের দুটি মামলা এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পতির জন্য আনলেও মামলা দুটি নিষ্পত্তি না হয়ে উচ্চ আদালতে ফেরত যায়। কারণ মামলার মূল্য-সংক্রান্ত বিষয়ে দুই পক্ষের সমঝোতা না হওয়ায় মামলা দুটি অনিষ্পন্ন অবস্থায় থেকে যায়। তারপর ওই অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত আর কোনো মামলা নিষ্পত্তির জন্য এডিআরে আসেনি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, এডিআরের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি হলে কাস্টমস ও আমদানিকারক উভয়পক্ষ লাভবান হয়। এতে দীর্ঘ বছর ধরে পড়ে থাকা মামলার জটও কমে। অন্যদিকে অনাদায়ী রাজস্ব আহরণ করতে পারে কাস্টমস। আবার আমদানিকারকও অনেক বছরের পড়ে থাকা ব্যাংক গ্যারান্টির বড় অংশ ফেরত পায়। তবে মামলা পড়ে থাকলে আমদানিকারকরা লাভ হয়। রাজস্বের টাকা তারা অন্য জায়গায় খাটাতে পারে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, এ আইন পরিবর্তন করে মামলা নিষ্পত্তির পর সুদসহ রাজস্ব দেয়া বিধান চালু করলে ব্যবসায়ীরা পয়সা খরচ করে উচ্চ আদালতে মামলা ফেলে রাখতেন না। বিপরীতে তারা মামলা জিতলে সুদসহ ব্যাংক গ্যারান্টির টাকা ফেরত পাবেন।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এ পর্যন্ত ১৪৪টি মামলা উচ্চ আদালতে নির্দেশে এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে। এসব মামলা ১০ থেকে ১৬ বছরের পুরোনো। ২০১২ সালের ১ মার্চ থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহযোগিতায় ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে এডিআর পদ্ধতি গতি পায়। এ পদ্ধতিতে আদালতের বাইরে আমদানিকারক এবং কাস্টমসের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে একজন নিরপেক্ষ সহায়তাকারীর মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করে থাকে।