Print Date & Time : 10 September 2025 Wednesday 11:26 am

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য কতটা প্রস্তুত আমাদের শিক্ষা খাত

আবুল কাসেম হায়দার: স্বাধীনতার ৫০ বছরে শিক্ষা খাত আমাদের অন্যতম অর্জন বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে চালু হয়। নতুন ধারণা, নতুন সম্ভাবনা সামনে রেখে কয়েকজন উদ্যোক্তা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হন। ২০১০ সালে নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নতুন মাত্রা লাভ করেন। প্রথমে ১৯৯২ এবং ১৯৯৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয় লাভের আশায়। কিন্তু ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নতুন রূপ লাভ করে। বর্তমানে দেশে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। ৫ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এ শিক্ষার্থীদের বড় অংশ বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে পড়ত। আজ তারা স্বদেশে পড়ালেখা করছে। এতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে।

ভবিষ্যতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু এদেশের শিক্ষার্থী নয়, বহু বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখার সুযোগ পাবে। এখনও নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপসহ অনেক দেশের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে।

মূল শিক্ষা খাত: ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় আমাদের স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৬ শতাংশের একটু বেশি। আর বর্তমানে ৫০ বছর পর আমাদের সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ মোটামুটি পড়তে ও লিখতে পারে। এক-চতুর্থাংশ এখনও পুরোপুরি অশিক্ষিত। এদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। এখনও অনেক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। এটি দুঃখজনক। সংখ্যার হিসাবে অনেক গ্রাম।

সরকারের জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়নের (এনএমএ) তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের এখনো গণিত ও বাংলায় দক্ষতা অর্জনের হার সন্তোষজনক নয়। ২০১৫ সালে বাংলায় দক্ষতা অর্জনের হার ছিল তৃতীয় শ্রেণিতে ৬৫ শতাংশ। আর গণিতে ওই বছরে কাক্সিক্ষত দক্ষতা অর্জনের হার ১০ শতাংশ।

সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা বর্তমানে ১৫৮টি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ৫১টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা ১০৭টি। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা কাজে বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধিকাংশই গবেষণা খাতে কোনো বরাদ্দ থাকে না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও অর্থের পরিমাণ নগণ্য।

শুধু সাক্ষরতার হার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নয়, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভর্তির হার, পাসের হার, ঝরেপড়া রোধ, ছাত্রছাত্রীদের সমতা, উপবৃত্তি, বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে বই দেয়া থেকে শুরু করে সংখ্যাগত দিক থেকে অর্জন ও উন্নতি বেশ দৃশ্যমান। তবে সংখ্যার ব্যাপক উন্নতি হলেও শিক্ষার মানের উন্নতি সেই হারে হয়নি।

স্বাধীনতার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মানগত উন্নতি খুবই কম। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য শিক্ষাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।

শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি: বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস ২০২০ অনুযায়ী ১৯৭২ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৭ হাজার ৭৯১টি। শিক্ষার্থী ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ লাখ। বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২০ হাজার ৮৪৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির চেয়ে বেশি। ১৯৭২ সালে কলেজ ছিল ৫২৬টি। বর্তমানে কলেজ রয়েছে ৪ হাজার ৬৯৯টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ লাখ। এছাড়া দেশে দাখিল ও আলিম মাদ্রাসা রয়েছে ৯ হাজার ৩০৫টি। এইগুলোতে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৫ লাখের অধিক।

বিদ্যালয় গমনের হার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও কোথাও শতভাগের কাছাকাছি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার পর এখন ১৮ শতাংশ। ২০০৫ সালে প্রাথমিক ঝরেপড়ার হার ছিল ৪৭ শতাংশ। এখন সারাদেশে সরকারি, বেসরকারি, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিও পরিচালিতসহ মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজারের কিছু বেশি। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ২৬ হাজারের অধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করেছে।

দেশে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে দুই কোটির বেশি শিক্ষার্থী। এর ৫১ শতাংশই ছাত্রী। ছাত্রীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলেজে শিক্ষার্থীর  সংখ্যায় সমতা এসেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রীর সংখ্যা কম। তবে মেডিকেলে ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রের চেয়ে বেশি।

প্রায় প্রতিটি উপজেলায় একটি করে মাধ্যমিক স্কুল, একটি করে কলেজ সরকারি রয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে বেশ অনিয়ম ছিল। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার অনিয়ম ও অভিযোগ কমেছে। অনলাইন ভর্তি পরীক্ষা, লটারির মাধ্যমে ভর্তি সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও অনিয়ম, দুর্নীতি কমেছে।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি: শিক্ষার মান নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন। শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু মানের দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের এখন শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। শিক্ষায় পরীক্ষা নির্ভরতা, শেখার চেয়ে ফলের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া, কোচিং, প্রাইভেট-নির্ভরতা, শিক্ষকদের এমপিওভুক্তসহ শিক্ষার বিভিন্ন খাতে নানা রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে মানুষের মধ্যে বিস্তর প্রশ্ন আছে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি করার পর তা বড় অর্জন বলা হলেও এক দশক পেরিয়ে গেলেও এই শিক্ষানীতিতে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করাসহ শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। বরং শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগ পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা না রাখার কথা থাকলেও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় উল্টো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড করে এই পরীক্ষাকে স্থায়ী করতে চাচ্ছে।

২০০৮ সালে শিক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুত না থাকায় তা ঠিক মতো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় অর্ধেক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পুরোপুরিভাবে সৃজনশীল প্রশ্ন করতে পারেন না। জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে একটি শিক্ষা আইন করার কথা রয়েছে। গত ১১ বছর ধরে তা আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা আইন আজও করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইনটি করা খুবই জরুরি।

শিক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন : ৫০ বছরে বাংলাদেশে যেসব বিষয়ে উন্নয়ন দৃশ্যমান, তার মধ্যে শিক্ষা খাত একটি। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ের সমতা অর্জনসহ শিক্ষার বেশ কিছু অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। তবে ৫০ বছর ধরে যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেই চ্যালেঞ্জ এখনো বিরাজমান। আর সেটি হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার মান অর্জন। শিক্ষার মানের সংকট বেশ দৃশ্যমান। সুতরাং এখন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র শিক্ষার মান উন্নয়নে অনেক বেশি নজর দিতে হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের দ্বারে কড়া নাড়ছে। এ বিপ্লবে জয়ী হতে শিক্ষা খাতকে সেই আলোকে দ্রুত সাজাতে হবে। বর্তমানে শিক্ষকের মানের প্রশ্ন বড়। শিক্ষকের বেতন কাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা খাতে আনতে হলেÑউন্নত দেশের আদলে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে নতুনভাবে তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল  ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ

সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

aqhaider@youthgroupbd.com