চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: ঝুঁকি ও সম্ভাবনা

আরিফুল ইসলাম আবির : চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা Industry 4.0 হলো শিল্প বিপ্লবের একটি পর্যায় যা ব্যাপকভাবে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ ও তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলনকে বোঝায়। যার মধ্যে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেম (সিপিএস), আইওটি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ক্লাউড কম্পিউটিং, কগনিটিভ কম্পিউটিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগুলো অন্তর্ভুক্ত। এর প্রভাবে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। চাকরি থেকে ব্যবসার ক্ষেত্র সব জায়গায় রোবোটিক্সের মতো প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পে এই উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার হবে সর্বাধিক।

তৈরি পোশাকশিল্প বৃহৎভাবে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে ধাবিত হলে এবং রোবট ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়লে এর ব্যাপক প্রভাব দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রেই দেখা যাবে। প্রথম সম্ভাব্য প্রভাব হলো চাকরি হারানো। গার্মেন্টস সেক্টর বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের একটি প্রধান উৎস এবং অটোমেশনের দিকে এর স্থানান্তর বর্তমান শিল্পে নিযুক্ত বিশালসংখ্যক  শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য চাকরি হারাতে পারে। এটি দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি স্বতন্ত্র শ্রমিকদের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

অন্যদিকে অটোমেশন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের ব্যবহারের দিকে পরিবর্তন গার্মেন্ট সেক্টরে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতি উপকৃত হতে পারে। এটি কাজের অবস্থার উন্নতির দিকেও নিয়ে যেতে পারে। কারণ রোবট এবং কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মানব কর্মীদের মতো একই সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতা ধারণ করে না। ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট দিয়ে করিয়ে নিয়ে কাজের পরিবেশকে ঝুঁকিমুক্ত করা যেতে পারে।

উপরন্তু, গার্মেন্ট সেক্টরে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটের ব্যবহার শ্রমিকদের জন্য বিশেষ করে প্রোগ্রামিং, রোবটের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত এবং তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নতুন দক্ষতা এবং নতুন কাজের সুযোগের বিকাশ ঘটাতে পারে। উৎপাদন খরচ কমলে তা বৈশ্বিক বাজারে পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করবে। যদিও সামগ্রিকভাবে এটি একটি জটিল সমস্যা এবং কীভাবে এর রূপান্তর পরিচালিত হয় এবং কীভাবে সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো ভারসাম্যপূর্ণ হয় তার ওপর নির্ভর করবে।

এশিয়ার অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, চীন-বাংলাদেশ তথা এশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বস্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা নিজেদের বাজারে ফেরানোর জন্য রোবটের মাধ্যমে জিন্স তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করেছে জার্মানির গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা এশিয়ার অর্থনীতির জন্য শঙ্কাজনক। শুধু চীন-বাংলাদেশ নয়, ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ এশিয়ার উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর রপ্তানি অর্থনীতির একটা বড় অংশ রেডিমেড গার্মেন্ট নির্ভর। বুনন শিল্প যদি রোবট নির্ভর স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিণত হয় তাহলে এসব দেশের হাজার হাজার গার্মেন্ট কর্মী কাজ হারানোর ঝ্ুঁকিতে পরবেন। মুখ থুবড়ে পরবে বৈদেশিক বাণিজ্য।

ইপিবির প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, মহামারির পর পোশাক রপ্তানির ১৩ মাসের পুনরুদ্ধার ও আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধির পর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের অক্টোবরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের  সামগ্রিক রপ্তানি আয় ৭.৮৫ শতাংশ কমে ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছরের এই সময় সার্বিক রপ্তানি আয় ছিল ৪.৭২ বিলিয়ন ডলার।

তবে অক্টোবরে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ৩.৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরের ৩.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ এসেছে পোশাক খাত থেকে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের আগে পোশাক খাতে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কাজ করতেন। তার মধ্যে ৬৫ শতাংশ ছিলেন নারী। ২০২০ সালে নারী ও পুরুষ কর্মীর হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ শতাংশ। ২০১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর পোশাক খাতের কর্মী বেড়েছে ১ শতাংশ হারে। এ সময়ে পুরুষ কর্মী ৪ শতাংশ হারে বাড়লেও নারী কর্মী কমেছে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ হারে।

যদি তৈরি পোশাকশিল্প মানুষের ওপর নির্ভরলতা কমিয়ে রোবটনির্ভর স্বয়ংক্রিয় উৎপাদন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিক শ্রেণির একটা বড় অংশ বেকার হয়ে যাবে, যা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও তথ্যের প্রবাহে শিল্পের স্বয়ংক্রিয়করণের অনেকগুলো ঝুঁকির একটা। অপরদিকে নতুন কর্মক্ষেত্রও সৃষ্টি হবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঝুঁঁকি মোকাবিলায় সরকার নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব পদ্ধতিকে যুগোপযোগী করা ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এখন সময়ের দাবি। একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য সরকার ও জনগণ উভয়কেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য আরও বেশি সচেতন ও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়