শেখ শাফায়াত হোসেন: ঋণের নামে বেরিয়ে যাওয়া অনেক টাকাই ব্যাংকে ফেরত আসছে না। এ সমস্যা যেমন নতুন নয়, তেমনি সমাধানের চেষ্টাও থেমে ছিল না। কিন্তু কার্যকর বা ফলপ্রসূ সমাধান এখনও আসেনি। এ কারণে অতীতের সব ঋণঝুঁকি নিরসনের প্রচেষ্টাগুলোর অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে বর্তমান সময়ের শিল্প খাতের বৈশিষ্ট্যে দ্রুত পরিবর্তনশীলতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা মূল্যায়নে ব্যাংকের দক্ষতা বাড়াতে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
‘ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং সিস্টেম’ সংক্ষেপে ‘আইসিআরআরএস’ শিরোনামের এ নীতিমালাটির আলোকে ব্যাংকগুলো এখন থেকে প্রত্যেক ঋণগ্রহীতার একটি রেটিং করবে এবং এ-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার তৈরি করবে। এ রেটিংয়ে পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন থাকবে।
মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে বিভাজন করবে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক ‘চমৎকার’ (এক্সিলেন্ট) বা ‘ভালো’ (গুড) রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে অর্থায়ন করতে পারবে। ‘প্রান্তিক’ (মার্জিনাল) রেটিংধারী গ্রাহককে পুরোনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিংধারীকে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো, যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়। ‘অগ্রহণযোগ্য’ (আনএকসেপ্টেবল) রেটিংভুক্ত গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দুবার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, রেটিং করার ক্ষেত্রে একটি পার্টি বা গ্রাহকের পরিমাণগত সক্ষমতায় ৬০ শতাংশ নম্বর এবং গুণগত সক্ষমতায় ৪০ শতাংশ নম্বর থাকবে। পরিমাণগত সক্ষমতা সূচকে ৬০ নম্বরের মধ্যে মোট গৃহীত ঋণ ও আর্থিক সক্ষমতায় ১০, চলতি দায় ও তরল সম্পদে ১০, মুনাফার সক্ষমতায় ১০, সুদ পরিশোধের সক্ষমতা ও নগদ প্রবাহের ওপর ১৫, পরিচালনগত দক্ষতায় ১০ এবং ব্যবসার মানের ওপর পাঁচ নম্বর থাকবে।
এছাড়া গুণগত সক্ষমতায় ৪০ নম্বরের মধ্যে কার্যদক্ষতার আচরণে (পারফরম্যান্স বিহ্যাবিয়র) ১০, ব্যবসা ও খাত ঝুঁকিতে সাত, ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিতে সাত, জামানত ঝুঁকিতে ১১, সম্পর্ক ঝুঁকিতে তিন, পরিপালন ঝুঁকিতে দুই নম্বর থাকবে।
এই রেটিংয়ে কোনো গ্রাহক ৮০’র বেশি নম্বর পেলে তাকে ‘চমৎকার’, ৭০-এর বেশি এবং ৮০’র কম নম্বর পেলে ‘ভালো’, ৬০-এর বেশি এবং ৭০-এর কম পেলে ‘প্রান্তিক’ এবং ৬০-এর নিচে নম্বর পেলে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেওয়া হবে।
তবে কোনো গ্রাহক গুণগত রেটিংয়ে যত নম্বরই পাক না কেন, পরিমাণগত রেটিংয়ে ৫০ শতাংশ নম্বর না পেলে তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিং দেওয়া হবে।
নীতিমালা অনুযায়ী এখন থেকে নতুন ঋণ, ঋণ নবায়ন ও বিদ্যমান ঋণ বর্ধিতকরণের প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অবশ্যই এ রেটিং সম্পন্ন করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এ রেটিং পদ্ধতিটিকে ফলপ্রসূ করার জন্য কোন কোন খাতের গ্রাহকের রেটিং করতে হবে, তার কিছু খাত-উপখাত নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
শিল্প খাতের মধ্যে তৈরি পোশাক, বস্ত্র, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, রাসায়নিক, সার, সিমেন্ট, সিরামিক, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙা, পাটকল, ইস্পাত প্রকৌশল, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে, কৃষিভিত্তিক ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সেবা খাতের আবাসন ও নির্মাণ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, টেলিকমিউনিকেশন ও অন্যান্য সেবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ঋণ দিতে হবে।
তবে ভোক্তাঋণ, ৫০ লাখ টাকার কম ঋণ আছেÑএমন ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ, ক্ষুদ্রঋণ, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ রেটিং অনুসরণ করতে হবে না।
পরিমাণগত সক্ষমতা মূল্যায়ন করবেন একজন ঋণ কর্মকর্তা। শাখা ব্যবস্থাপক করবেন গুণগত মূল্যায়ন। ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হবে আইসিআরআর। এর নির্বাহী সারসংক্ষেপ (এক্সিকিউটিভ সামারি) প্রতিবেদন অনুমোদন করবেন ব্যাংকের প্রধান ঝুঁকি কর্মকর্তা। পরিমাণগত রেটিংয়ের জন্য ঋণের আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ নিরীক্ষিত প্রতিবেদন কাজে লাগাবে ব্যাংক। নতুন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ক্ষেত্রে ব্যাংক একটি প্রাক্কলিত আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে এই রেটিং করবে; তবে কোনোভাবেই এ ধরনের গ্রাহককে ‘প্রান্তিক’ রেটিংয়ের বেশি দেওয়া যাবে না। গ্রাহকের গুণগত মূল্যায়ন বা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ নথি সংরক্ষণ করতে হবে।
আইসিআরআর নীতিমালায় এমন ২০টি মডেল দেওয়া আছে, যা কার্যকরভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা হলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা অনুযায়ী ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এই মডেল সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা ছিল বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এর আগে ২০০৫ সালে ঋণঝুঁকি নিরসনে ক্রেডিট রিস্ক গাইডলাইন ম্যানুয়াল (সিআরজিএম) জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতদিন ওই ম্যানুয়াল অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নির্ণয় করে ঋণ বিতরণ করত। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সিআরজিএম ও আইসিআরআর একসঙ্গে অনুসরণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে। আগামী জুলাই থেকে কেবল আইসিআরআরএস অনুসরণ করতে হবে। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ নীতিমালাটির উদ্বোধন করবেন গভর্নর ফজলে কবির।
এ নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. আবদুর রহিম (বর্তমানে বিআইবিএম’র মহাপরিচালকেরও দায়িত্বে) শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা আশা করি এ নীতিমালা এবং মডেল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার হাতিয়ারগুলোতে মূল্য সংযোজন করবে। ব্যাংকগুলোকে একটি তুলনামূলক ভালো মানের ঋণ-পোর্টফোলিও উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা করবে।’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৯৩ সালে ব্যাংক খাতে ঋণঝুঁকি নির্ণয়ে ‘লেন্ডিং রিস্ক অ্যানালাইসিস (এলআরএ)’ কাঠামোর সূচনা করে। এক কোটি টাকার বেশি অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে এলআরএ কাঠামো প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু ওই কাঠামোটি খুব একটা কাজে না আসায় ২০০৩ সালে ‘কোর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন (সিআরএমজি)’ চালু করা হয়

Print Date & Time : 18 July 2025 Friday 6:00 am
‘চমৎকার’ ও ‘ভালো’ রেটিং না হলে ঋণ নয়
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: