ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন

চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান বাড়বে ১৩ হাজার কোটি টাকা

ইসমাইল আলী: গত মে মাস থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার আনুষ্ঠানিক অবমূল্যায়ন শুরু হয়। এ সময় ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থেকে গিয়ে ঠেকেছে ১০৬ টাকায়। যদিও খোলাবাজারে ডলার আরও বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডলারের এ অবমূল্যায়নে অর্থনীতির নানা খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিদ্যুৎ খাত। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও ডলারের কারণে লোকসান বাড়ছে এ খাতে।

সূত্রমতে, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় ডলারে। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের একটি অংশও ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ফলে ডলারের অবমূল্যায়নে এ খাতে ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। সংস্থাটির এক হিসাবে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির লোকসান হয়েছে রেকর্ড ৩১ হাজার আট কোটি ৩২ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে সংস্থাটির সম্ভাব্য লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫১ হাজার ৮৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসান বাড়বে প্রায় ২০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থাকলে চলতি অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াত ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তবে ডলারের দর ১০৭ টাকা হলে এ লোকসান বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু ডলারের অবমূল্যায়নের জন্য লোকসান বেড়ে যাবে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে, তারপরও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়।

ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয় না। তবে আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হারে। ফলে সরাসরি ডলার না লাগলেও কয়েক মাসে টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের ফলে লোকসান বৃদ্ধির বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তবে এটা সরকারের নীতিগত বিষয়। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার কিছু নেই।

গত জুনে অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে পিডিবি জানায়, ডলারের এক টাকা বিনিময় হার বৃদ্ধিতে পিডিবির লোকসান বাড়ে বছরে ২৩০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে করণীয় কীÑজানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, যেসব কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ আছে, তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হারে পরিশোধ করা যেতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে ঋণের

 পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে যেসব কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ নেই তাদের ক্ষেত্রে চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য বাদ দিয়ে সরাসরি দেশীয় মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এজন্য চুক্তি সংশোধন করতে হবে।

যদিও বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর ডলারের বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বছরের শুরুতে এ হার ছিল ৮৫ টাকা। অর্থাৎ বিনিময় হার ১৫ টাকা বাড়বে। এতে পিডিবির লোকসান অনেক বাড়বে। তাই চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।

পিডিবির তথ্যমতে, ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে দেখতে শুরু করেছে বিদ্যুৎ খাতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই (জুলাই-আগস্ট) রেকর্ড লোকসানের মুখে পড়েছে পিডিবি। এ দুই মাসে পিডিবি লোকসান গুনেছে আট হাজার ৮৮৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অথচ ২০১৯-২০ অর্থবছরে (পুরো বছরে) সংস্থাটির লোকসান ছিল মাত্র সাত হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছর জুলাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫১১ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এজন্য জ্বালানি ব্যয় হয় চার হাজার ৩০৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর জ্বালানিবহির্ভূত (ক্যাপাসিটি চার্জ এবং পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়) ব্যয় ছিল দুই হাজার ১০ কোটি ২০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয় ৬ হাজার ৩১৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যয় যোগ করে জুলাইয়ে পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় চার হাজার ২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এদিকে আগস্টে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৪৯৭ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এতে জ্বালানি ব্যয় হয় পাঁচ হাজার ৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং জ্বালানিবহির্ভূত ব্যয় ২ হাজার ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট ব্যয় হয় সাত হাজার ১১১ কোটি ২০ লাখ টাকা। অন্যান্য ব্যয় যোগ করে ওই মাসে পিডিবির মোট লোকসান দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।