ইসমাইল আলী: বাংলাদেশে রপ্তানির জন্য ভারতের ঝাড়খণ্ডে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে দেশটির বেসরকারি কোম্পানি আদানি পাওয়ার। আর বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বিনিয়োগে বাগেরহাটে চলছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ। কেন্দ্র দুটির উৎপাদন সক্ষমতা ধরা হয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট ও এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। ২০২০ সালে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও দফায় দফায় পেছাচ্ছে এগুলোর নির্মাণকাজ।
সর্বশেষ চলতি মাসে উৎপাদনে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির। তবে এটিও পিছিয়ে গেছে। চলতি বছর পাওয়া যাচ্ছে না কয়লাভিত্তিক এ দুই বড় কেন্দ্রের বিদ্যুৎ। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিপিডিবির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ ৮৪ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ শেষ হলে আগামী ডিসেম্বর নাগাদ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট কমিশনিং করা হবে। তবে কমিশনিংয়ের পরই কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাবে না বাংলাদেশ।
এ বিদ্যুৎ দেশে আসতে আরও কিছু সময় লাগবে। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট আগামী বছর মার্চ নাগাদ চালু হতে পারে। মূলত কভিড মহামারির কারণেই আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যথাসময়ে উৎপাদনে আসার বিষয়টি বিলম্বিত হয়েছে।
বর্তমানে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎ গ্রিড লাইনে যুক্ত হলে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণ দাঁড়াবে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট, যা বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ১০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, শুরুতে কথা ছিল গত বছর এ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হবে। তবে করোনার জন্য তা পিছিয়ে যায়। এরপর তা পিছিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং মে মাসে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। পরে তা বাড়িয়ে প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার সময় হিসেবে জুন ও সেপ্টেম্বরে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে তা আবারও পিছিয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারত ও বাংলাদেশ অংশের গ্রিড লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও বগুড়ায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের কাজ চলছে। এ উপকেন্দ্রের জন্য চীন থেকে যন্ত্রাংশ আসছে। তবে এক্ষেত্রেও পড়েছে করোনা মহামারির প্রভাব। সম্প্রতি চীনে কভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে আসতে দেরি হচ্ছে। এসব যন্ত্রপাতির দেশে পৌঁছার ওপরই নির্ভর করছে বিদ্যুৎ আমদানি কার্যক্রম শুরুর বিষয়টি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার জন্য ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতামূলক ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। মূলত এ চুক্তির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ভারত সরকারের সহযোগিতা বাড়ানো। এরই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে ভারতীয় বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আদানি পাওয়ারের সঙ্গে এমওইউ সই করে বিপিডিবি। এর মাধ্যমে ভারত থেকে এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে চুক্তি হয়। তবে কেন্দ্রটি থেকে নিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে বিপিডিবির সঙ্গে আদানির বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৫ বছর মেয়াদি এ বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয় ছয় টাকা ৮৯ পয়সা (৮ দশমিক ৬১২ সেন্ট)। যদিও কয়লার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় খরচ বাড়বে বলে মনে করছেন বিপিডিবি সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২০২০ সালে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটির কারণে প্রায় তিন মাস বন্ধ রাখতে হয় রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ। ফের শুরু করতে আরও তিন মাস সময় লেগে যায়। আবার গত বছর করোনার কারণে পুনরায় ব্যাহত হয় নির্মাণকাজ। এ কারণে দুই দফা পিছিয়েও চলতি মাসে উৎপাদনে আসতে পারছে না রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে খুলনার রামপালে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সুন্দরবন-সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার সাপমারি-কাটাখালী ও কৈর্গদাশকাঠী এলাকায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। এক হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপরে কয়লাভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড। এতে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, প্রকল্পটির অগ্রগতি ৭৯ শতাংশ। চলতি মাসে প্রথম ইউনিট ও সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। তবে তা পিছিয়ে ডিসেম্বরে এর প্রথম ইউনিট এবং আগামী বছর মার্চে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় এ কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসতে বিলম্ব হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূলত উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগের বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্য থেকেই আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসনে ভ‚মিকা রাখবে রামপাল। এছাড়া জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎপ্রবাহ বাড়ানোও ছিল অন্যতম লক্ষ্য। তবে করোনার জন্য প্রকল্প দুটি কয়েক দফা পিছিয়ে গেছে। এছাড়া সঞ্চালন লাইনের কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। সে কাজ দ্রæত গিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে পিজিসিবি।