নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁদপুর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে কেলেঙ্কারি, পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে বালি উত্তোলনসহ বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগে চাঁদপুর সদর উপজেলার ল²ীপুর ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
গতকাল চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের প্রধান শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নির্দেশনায় এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপরাধে সেলিম খানকে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পদ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে হাইমচর উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারীকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল জানান, গতকাল জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের প্রধান শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নির্দেশনায় এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিভিন্ন অপকর্মের মাধ্যমে দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করায় চাঁদপুরের ১০নং মডেল ল²ীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সভায় উপস্থিত ছিলেনÑজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভ‚ঁইয়া, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আব্দুর রব ভূইয়া, আব্দুর রশিদ সর্দার, আবুল খায়ের পাটোয়ারী, মঞ্জুর আহমেদসহ কার্যনির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
জানা গেছে, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভ‚মি অধিগ্রহণের জন্য ল²ীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনা পাড়ে একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে ৬২ একর ভ‚মি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারম্যান সেলিম খান তার ছেলেমেয়েসহ অন্যান্য জমির মালিকরা অস্বাভাবিক মূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) তদন্ত করে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনার তথ্য জানতে পারেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভ‚মি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে সাবেক ডিসি অঞ্জনা খান মজলিশ উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন।
কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণ করা দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য অস্বাভাবিক। এছাড়া এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর ল²ীপুর মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। এ ছাড়া মৌজা মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভ‚মি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যায় পড়ত।
অন্যদিকে, চাঁদপুরের নদী অঞ্চলে শত শত ড্রেজার বসিয়ে গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালি উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানসহ একটি চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুমতি ছাড়াই চেয়ারম্যান বছরের পর বছর বালু বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। দীর্ঘদিন বালি ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অপরিকল্পিত বালি উত্তোলনের কারণে নদীভাঙন প্রতিরোধে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ জাতীয় সম্পদ ইলিশের বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে। এমনকি সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে। এ অবস্থায় চাঁদপুরের নদী থেকে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন বন্ধে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষজনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় বিআইডবিøউটিএ, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, পানি উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতামত ও চিঠির আলোকে সরকারি সম্পদ ও ইলিশ রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নদী রক্ষা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেন অঞ্জনা খান মজলিশ। ওই চিঠির পর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৈঠক করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ভ‚মি মন্ত্রণালয়ও। এরই মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ ও চেয়ারম্যান সেলিম খানকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন নদীপাড়ের ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ। তবুও বালি উত্তোলনের জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন সেলিম খান; যা সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন বাণিজ্য।
এছাড়া গত ৬ এপ্রিল সেলিম খানের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ যাচাইয়ে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লার সহকারী পরিচালক রাফী মো. নাজমুস সা’দাতের নেতৃত্বে দুদক এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণের সুযোগে ৩৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা ও অনেক বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। সংস্থাটি এখন আরও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। তথ্য সংগ্রহ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
অন্যদিকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে হাইমচর উপজেলা চেয়ারম্যান নূর হোসেন পাটোয়ারীকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই নূর হোসেনের বিরুদ্ধে নদীতীর সংরক্ষণ প্রকল্পে ঠিকাদারির নামে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে কাজ না করেই অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।