চাঁদপুরে ফসলি জমির টপ সয়েল যাচ্ছে ইটভাটায়

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরের আট উপজেলায় ইটভাটাগুলোয় ব্যবহƒত হচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি। জমির এই মাটি ব্যবহার করে ইটভাটা মালিকরা তৈরি করছে ইট। ফসলি জমির উর্বর মাটি বা টপ সয়েল ইটভাটায় চলে যাওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব ফসলি জমি। আর এতে কমছে ফসলি জমির পরিমাণ। দিন যতই যাচ্ছে ততই হ্রাস পাচ্ছে জেলার ফসল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার হার। ফসলি জমি রক্ষায় প্রশাসন জেলার হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর ও চাঁদপুর সদর উপজেলায় আর আগের মতো কয়েক দিন পরপর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা না করার অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার মধ্যে হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলায় মাটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। হাজীগঞ্জ উপজেলার হাটিলা পূর্ব ইউনিয়নের হাড়িয়াইন আড়ং বাজারের উত্তর পাশে বাইতুল মামুর জামে মসজিদের পূর্ব পাশে এক্সাভেটর দিয়ে টপ সয়েল কেটে আওয়াম লীগ নেতার ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে। এতে গ্রামীণ রাস্তা ভেঙে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লেও স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার। স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। অপরদিকে হাজীগঞ্জ ৫নং সদর ইউনিয়নের দোয়ালিয়া গ্রামের পশ্চিম মাঠে দোয়ালিয়া-রামপুর বাজার রাস্তার পাশেই এক্সাভেটর দিয়ে রাতের আঁধারে মাটি কেটে পার্শ^বর্তী ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, হাজীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের নাজির ইব্রাহিম নিয়ন্ত্রণ করছেন মাটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং বর্ষা মৌসুমে নিয়ন্ত্রণ করছেন ড্রেজার ব্যবসায়ীদের।

শাহরাস্তি উপজেলার মেহের রেলস্টেশনের এক কিলোমিটার পশ্চিমে রেললাইন-সংলগ্ন দক্ষিণ মাঠে এক্সাভেটর দিয়ে মাটি কেটে ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে। উপজেলার উপলতা গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী খোরশেদ জমির টপ সয়েল কাটার কথা স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করার পরও এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো অভিযান না করে মাটি ব্যবসায়ীকে মাটি কাটার সুযোগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। পরে শাহরাস্তি থানা পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে একজনকে আটক করে।

অপরদিকে কচুয়া উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা অনেকটা বীর দর্পেই চালিয়ে যাচ্ছেন ফসলি জমি বিনষ্ট করে ইটভাটায় মাটি সরবরাহ বাণিজ্য। উপজেলার মনারটেক এলাকায় এখনও ১০টি ড্রাম ট্রাকে তিনি মাটি সরবরাহ করছেন কালোচোঁ গ্রামের এইচবিবি ইটভাটায়। দিন-রাত ফসলি জমির টপ সয়েল কাটা অব্যাহত থাকলেও কচুয়া উপজেলা প্রশাসন ফসলি জমি রক্ষায় রয়েছে বরাবরই  নির্বিকার।

জানা গেছে, জেলায় ইটভাটা ব্যবসা পরিচালনা ও ফসলি জমির মাটি কেনাবেচার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের-দপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, পরিবহন নেতা, কতিপয় স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। এ সিন্ডিকেটের মধ্যে শাহরাস্তির সিন্ডিকেট বেশ সক্রিয়। স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় কর্তাব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতা বলয়ে থাকা ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই চলে শাহরাস্তিতে ফসলি জমির টপ সয়েল বিক্রির মহোৎসব। শাহরাস্তিতে অবৈধ ইটভাটাও রয়েছে অনেক। স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা আর ‘ম্যানেজ’ প্রক্রিয়ায় ইটভাটাগুলো চলমান রয়েছে। এই উপজেলায় মাটি কিনতে আগে থেকেই ইটভাটা মালিকরা দাদন তুলে দিচ্ছেন সিন্ডিকেটের সদস্যদের হাতে। সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরা আবার গ্রামে গ্রামে তাদের লোক পাঠাচ্ছেন জানার জন্যÑকোন কোন কৃষক পরিবার অসুবিধায় আছেন। কৃষকের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কৌশলে টাকা ধার দেয়া হয় কৃষকদের। সিন্ডিকেটের লোকেরা কারসাজি করে কৃষকদের বিপদের সময় বর্ষা মৌসুম বা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে দাদন দিয়ে ফাঁদে ফেলে কৃষকের জমির উর্বর মাটি কিনে নিচ্ছেন।

অন্যদিকে বিভিন্ন উপজেলার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বারবার বারণ করা সত্ত্বেও ইটভাটা মালিকরা উর্বর মাটির ব্যবহার করে ইট বানাচ্ছেন। এ নিয়ে সচেতন মহলের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। চাঁদপুরের আট উপজেলায় কর্মরত কৃষি কর্মকর্তারা উর্বর ভূমি কমে যাওয়ার বিষয়টি জানলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ইট বানানোর জন্য ফসলি জমির এক ফুট পর্যন্ত মাটি কিনে নিচ্ছেন ইটভাটার মালিকরা। কোথাও আবার পুরো জমির মাটি কিনে নিচ্ছেন। এতে উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে ফসলি জমিগুলো। এ কারণে প্রতি বছরই কমছে ফসল উৎপাদন।

বিভিন্ন উপজেলায় ড্রামট্রাকে মাটি পরিবহনের ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাঁচা-পাকা বিভিন্ন সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লেও থেমে নেই সিন্ডিকেটের মাটি বাণিজ্যের মচ্ছব। হাজীগঞ্জ উপজেলায়য়আতিক শাহ ব্রিক ফিল্ডে মাটি পরিবহনকারী এক ড্রামটাক চালক  নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, মূলত কৃষক যে জমিতে ফসল কম উৎপাদন করতে পারে, সে জমিরই মাটি বিক্রি করে। আমরা কারও কাছ থেকে জোর করে মাটি কিনি না। তবে মাটি কেনার কাজ বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ করে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।

চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মেদ সিদ্দীকি মুঠোফোনে জানান, ফসলি জমির উর্বর মাটি ব্যবহার করলে স্বাভাবিকভাবেই সেই জমিতে ফসল উৎপাদন কম হয়। তাই ইটভাটায় ফসলি জমির উর্বর মাটি ব্যবহারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আমরা কৃষকদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।

চাঁদপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান জেলার অবৈধ ইটভাটার তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, কোনো উপজেলায় কতটি অবৈধ ইটভাটা আছে, সে সংখ্যা বলা যাবে। তবে ইটভাটার নাম বলতে নারাজ এই কর্মকর্তা। অবৈধ ইটভাটার মালিকদের সাথে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে কর্মরত কতিপয় কর্মকর্তার অবৈধ লেনদেনের আঁতাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পরিবেশ বিপর্যয় হতে পারে, এমন স্থানে আর কোনো নতুন ইটভাটার পরিবেশের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে চাঁদপুরে মোট ৯৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৫০টি বৈধ এবং ৪৩টি অবৈধ হলেও হাইকোর্টে রিট করে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।