চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রীর ভাইসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক: চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রীর ভাইসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।জেলার হাইমচর উপজেলায় ৪৮ একর সরকারি সম্পত্তি প্রতারণার মাধ্যমে রেজিস্ট্রি দলিল সৃষ্টি করে মালিকানা হস্তান্তর করার অভিযোগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়।
বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) চাঁদপুরের সহকারী জজ মো. মহিউদ্দিনের আদালতে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের পক্ষে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন সরকারি কৌঁসুলি মো. আব্দুর রহমান।
মামলায় শিক্ষামন্ত্রীর বড় ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপুসহ ২৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। অপরদিকে গ্রহীতা হিসেবে জমি দখলে নেয়ার কারণে মামলায় প্রথমপক্ষের বিবাদীরা হলেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন আহমেদ, হুমায়ুন কবির পাটওয়ারী, মো. মুনছুর আহম্মদ, শিক্ষামন্ত্রীর চাঁদপুরস্থ প্রতিনিধি মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন।
সাফ কবল ও দানপত্রমূলে জমি দাতা হিসেবে দ্বিতীয়পক্ষের বিবাদী করা হয়েছে- হাইমচরের মৃধারকান্দি এলাকার আ. ফারুক সরদার, আবুল সরদার, ঢাকা মিরপুরের নুর মোহাম্মদ, মাসুম হোসেন, শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের পিয়ারা বেগম, আকলিমা বেগম, তছলিমা বেগম, মো. সুমন মিয়া রিদয়, ফাহিমা আক্তার, মো. শরীফ মিয়া, হাইমচরের নূর মোহাম্মদ, লক্ষীপুরের জয়নাল আবেদীন মোল্লা, মিরপুরের মাজেদা বেগম, মো. নাছির মৃধা, মো. রাসেল, হাসিনা আক্তার, শাহীনা বেগম, মোহাম্মদপুরের মো. সালাউদ্দিন, মো. ফিরোজ ইকবাল। তৃতীয়পক্ষের বিবাদী করা হয়েছে হাইমচর উপজেলার সাবেক সাব-রেজিস্টার অসীম কল্লোলকে। ইতোমধ্যেই তৎকালীন সাব রেজিস্টার অসীম কল্লোলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
মামলার বিবরণীতে জানা যায়, হাইমচর উপজেলার সোনাপুর-তাজপুরে ১৯৫০ সালে বাহেরচর মৌজায় চর জেগে ওঠে, যা পরে পয়স্তি ভূমি হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারি খাসজমি হওয়ায় এ, বি ও সি ক্যাটাগরি করে তা স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু এক নম্বর বিবাদীসহ অন্যরা ভুয়া ও জাল দলিল তৈরি করে সেখানে প্রায় সাড়ে ৪৮ একর জমি হাতিয়ে নেন। এতে আরও বলা হয়, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। এ পরিস্থিতিতে সবকিছু যাচাই-বাছাই করে সরকারি জমি উদ্ধারে দেওয়ানি মামলা করা হয়।
অভিযুক্ত ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপুসহ প্রথম ৫ জন হাইমচরের নীলকমল ইউনিয়নের বাহেরচরের নদী সিকস্তি ৪৮.৫২৫০ একর ভূমি ৬টি দলিলে মার্চ, এপ্রিল ও জুলাই মাসে সাফকবল ও দানপত্রের মাধ্যমে দ্বিতীয়পক্ষের বিবাদীদের কাছ থেকে নিজেদের নামে নিয়ে নেন। উক্ত ভূমি সিএস জরীপকালিন সময়ে নদী সিকস্তি অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে সরকারি স্বত্ব স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে ৪/৭৭-৭৮ রিসেটেলমেন্ট মামলার মাধ্যমে হাত নকশা তৈরি করে এবং হাতে লেখা এ, বি, সি, ব্লক নামকরণে একটি জমাবন্দি তৈরি করা হয়। সেই সাথে চাষাবাদ করার জন্য স্থানীয় কৃষকদের বন্দোবস্ত দেয়া হয়। কিন্তু কোন প্রকার কবুলিয়তনামা দলিল সম্পাদিত হয়নি। তখন সরকারি স্বার্থে দাখিলার মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আদায় করা হতো। এ অবস্থায় বর্ণিত জমিতে ভোগ দখলরত চাষী কোন স্বত্ব স্বার্থ উপজাত হয়নি। সিএস, আরএস, বিএস জরীপকালীন সময়েও ওই জমি জলমগ্ন থাকায় কোন জরিপ করা সম্ভব না হওয়ায় ভূমির দাগ খতিয়ান ও মৌজার নম্বর হয়নি। এ অবস্থায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক গত বছরের ৩১ আগস্ট এ মৌজার জরিপ কাজ সম্পন্ন করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে চিঠি দেন।
নালিশী ভূমিতে ২য় পক্ষের বিবাদীগণের কোন প্রকার স্বত্ব স্বার্থ ছিল না এখনো নেই। রিসেটেলমেন্ট মোকদ্দমামূলে সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে তাদেরকে শুধুমাত্র ভোগ-দখল করার জন্য দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ২য় পক্ষের বিবাদীরা উক্ত ভূমির প্রতি অন্যায় ও বেআইনিভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার জন্য প্রথমপক্ষের বিবাদীগণকে বুঝিয়ে বিভ্রান্ত করে জমি হস্তান্তর করে বলে বাদীপক্ষ সম্প্রতি জানতে পারে। হস্তান্তরের এমন কোন অধিকার তাদের নেই।নালিশে আরও উল্লেখ করা হয়, এ ৪৮ একর সম্পত্তি গ্রহীতা বিবাদীগণ এবং অপর বিবাদীরা দাতা হিসেবে হাইমচর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলগুলো সৃজন করায় সরকারপক্ষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাই এ দলিলগুলো যোগসাজস, তঞ্চকতামূলক হওয়ায় তা অকার্যকর ও বাতিল করার আবেদন জানানো হয়। সেই সাথে মোকদ্দমার খরচ ও ক্ষতিপূরণও চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারি কৌঁসুলি মো. আব্দুর রহমান বলেন, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন জারির নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার শুনানির তারিখ ৩১ মে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক- রাজস্ব দাউদ হোসেন চৌধুরী বলেন, আমরা সরকারপক্ষে মামলা দায়ের করেছি- সরকারি সম্পত্তি সরকারের কাছে নিয়ে আসার জন্য। এ মামলায় ৫ জন জমি গ্রহিতা এবং ১৯ জন জমিদাতা এবং একজন সাব রেজিস্টারকে বিবাদী করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা ৪৮ একর জমির দলিল পেয়েছি শুধুমাত্র এ জমি উদ্ধারেই মামলা হয়েছে। ওনারা আরও জমি নিয়েছে কি না বা আরও বেশি দখল করেছে কি না তা এখানে আসেনি।
সাব রেজিস্টারকে বিবাদী করা সম্পর্কে তিনি বলেন, তিনি জানেন এখানে জরিপ হয়নি। এগুলো সরকারি জমি। তারপরও তিনি কিভাবে রেজিস্ট্রি করলেন। যদি আমরা রায় পাই তখনতো এ দলিলগুলো বাতিলের জন্য তাকে অর্ডার দিবে।
সাবেক সাব রেজিস্টার অসীম কল্লোল সম্পর্কে তিনি বলেন, আগের যে সাব রেজিস্টার ছিলেন তিনি আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত হওয়ায় আমরা ইতোমধ্যেই তার অপকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘খাস জমি উদ্ধার ও দলিল বাতিলের জন্য সরকারের পক্ষে মামলাটি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে জমিজমা সংক্রান্ত কোনো মামলা হলে সেটার বাদী হন জেলা প্রশাসক। সে হিসেবে আমি মামলার বাদী হয়েছি। দেওয়ানী মামলাটিতে ২৫ জনকে বিবাদী করা হয়েছে, যারা জমির দলিলগুলো সৃজন করেছেন।’
মামলার প্রধান প্রতিপক্ষ ডা. জাওয়াদুর রহিম টিপু পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান করছেন।
হাইমচরের বাহেরচর নামক ওই এলাকাটি বর্তমানে শিক্ষামন্ত্রীর ভাইয়ের নাম অনুসারে ‘টিপুনগর’ হিসেবে পরিচিত।