বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: চাঁদপুরে গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন জেলার আট উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। জলাবদ্ধতায় বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ফসলের মাঠসহ হাজার হাজার মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন নিš§আয়ের মানুষসহ মৎস্য ও পশু খামারিরা। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। পানিবন্দি এলাকায় রয়েছে পর্যাপ্ত খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটসহ পশুখাদ্যের সংকট। জেলা প্রশাসনসহ সামাজিক রাজনৈতিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিজ নিজ উদ্যোগে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষকে সহায়তা করছেন। জেলা প্রশাসন উপজেলাভিত্তিক বরাদ্দকৃত ত্রাণের কোনো পরিমাণ উল্লেখ না করেই ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রাখায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ত্রাণসহায়তা সীমিত থাকায় ক্রমেই বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শাহরাস্তি উপজেলার মনিপুর, খিতারপাড়, চান্দল, কাদরা, উল্ল্যাশ্বর, দহশ্রী, আয়নাতলী, যাদবপুর, শোরশাক, দেহেলা, খেড়িহরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল এলাকায় এখনও হাঁটুপানি রয়েছে। এখন পর্যন্ত এসব এলাকার অনেক স্থানেই সরকারি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ মনিপুর-খিতারপাড় প্রবাসী মানবকল্যান সংস্থার পক্ষ থেকে পানিবন্দি মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভেসে গেছে অসংখ্য খামারির মাছের ঘের।
শাহরাস্তি উপজেলার হাড়াইরপাড় গ্রামের মিজানুর রহমানের ছেলে মাহমুদুল হাসান জানান, পার্শ^বর্তী অনেক এলাকায় পানি উঠেছে। মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আমার ছয়টি পুকুরসহ একটি বেড়ির মাছ চলে গেছে। শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী আর এম উচ্চ বিদ্যালয়, চিতোষী সুলতানিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, সূচিপাড়া ডিগ্রি কলেজ, পঞ্চনগর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ।
জেলার হাইমচর উপজেলার নীলমকল ইউনিয়ন ভাঙনের কবলে পড়েছে। বন্যায় কারণে মৎস্য ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। অপরদিকে চাঁদপুর সদরের রাজরাজেশ্বর চরের মানুষের ঘরবাড়িতে এখন হাঁটু সমান পানি থাকায় সেখানখার মানুষজন ঝুঁকিতে রয়েছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাত থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ও ইব্রাহীমপুর ইউনিয়নের কিছুটা শঙ্কামুক্ত। প্রত্যেক উপজেলায় মনিটরিং করার জন্য কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
এদিকে টানা বৃষ্টিতে ডাকাতিয়া নদীর পানি এক থেকে দুই ফুট ওঠানামা করছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া পদ্মা-মেঘনায় রয়েছে প্রবল স্রোত। জেলার হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ফরিদগঞ্জসহ ডাকাতিয়া নদীপাড়ের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে হাজীগঞ্জ উপজেলার ১০নং গর্ন্ধব্যপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত ২০টি পরিবার, ৯নং গর্ন্ধব্যপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নাসিরকোটের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। হাজীগঞ্জ পৌরসভার রান্ধুনীমুড়া এলাকার তৃপ্তি মৎস্য ফিশারির স¡ত্বাধিকারী মুন্সী মোহাম্মাদ মনির। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছেন। সম্প্রতি এলাকায় ২৭টি পুকুরে রুই, কাতল, থাই পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ফেলে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ভারী বৃষ্টিপাতে তার পুকুরের অনেক মাছ ভেসে গেছে। এতে তার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। অপরদিকে একই এলাকার জসিম চৌধুরী জনি নামের আরেক মৎস্য খামারির ছয়টি বেড়ির মাছ ভেসে গেছে। এতে তার প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া জানান, খোঁজখবর নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণসহ তালিকা করা হচ্ছে। হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ বিভিন্ন ইউনিয়নে থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস শীল।
জেলার সবচেয়ে বড় বড় মৎস্য প্রজেক্ট ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলায় অন্তত ৬০টিরও বেশি চরে মৎস্য চাষ করা হচ্ছে। গাজীপুর চরের মৎস্য চাষি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ৪০ জন বড় মৎস্য চাষি রয়েছে। শত কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। নেট দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সরকার যেন এই চাষিদের প্রতি সুনজর দেয়।’
ফরিদগঞ্জ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বিভিন্নভাবে প্রজেক্ট ও পুকুরের মাছ রক্ষার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে।’ চাঁদপুর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আতিক হোসেন জানান, ‘জোয়ার-ভাটার প্রভাবের কারণে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার পানি সন্ধ্যা ৭টায় ছিল ৩ দশমিক ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। চার সেন্টিমিটার হলে বিপৎসীমার ওপরে উঠবে পানি। সেই তুলনায় এখনও চাঁদপুরের অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে।’
অপরদিকে মতলব উত্তরের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে মেঘনা নদীরপাড় দিয়ে বয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে স্বেচ্ছাসেবক টিম স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কয়েকটি গর্ত মেরামত করতে দেখা গেছে। মেঘনা ধনাগোদা প্রকল্প প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কেউই বাঁধ রক্ষায় ততটা তৎপর নয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ায় বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের কাজ করা হবে বলে জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্লোল কিশোর সরকার বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে উপজেলার অনেক ফসল নিমজ্জিত। বৃষ্টি কমলে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দেব তারা যাতে নাবি জাতের অর্থাৎ আমনের বিআর-২২ ও ২৩ জাত আবাদ করতে। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাব।’
হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. শাহীন মিয়া জানান, বসতবাড়িতে পানি ওঠে যাওয়ায় হাজীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গবাদিপশু নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন খামারিগণ।খামারিদের আমরা আমাদের সেবা দেয়া অব্যাহত রেখেছি।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা অন্যান্য দুর্যোগের সময় কৃষকদের যেমন তালিকা করি, এক্ষেত্রে সেভাবে তালিকা করা হবে। যাতে করে পরবর্তী মৌসুমে এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা যায়।’