প্রতিনিধি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : এসএসসি নির্বাচনি পরীক্ষায় দুই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের তদবির না শোনায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে মারধর ও লাঞ্ছিতের অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর মেয়র মোখলেসুর রহমান ও তার লোকজনের বিরুদ্ধে। শনিবার (১৫ অক্টোবর) রাত ১১টায় শহরের ঢাকা বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থিত আরাফাত বোর্ডিংয়ে এ ঘটনা ঘটে।
মেয়র কর্তৃক লাঞ্ছিতের শিকার ওই শিক্ষক জেলা শহরের ঐহিত্যবাহী রাজারামপুর হামিদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলাম।
জানা গেছে, এসএসসি নির্বাচনি পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষাকেন্দ্রে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নকল করার অপরাধে দুই ছাত্রকে বহিষ্কার করে রাজারামপুর হামিদুল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) এসএসসির টেস্টের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় মোবাইল দেখে নকল করছিল ওই দুই ছাত্র। পরে ধরা পড়লে শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা করে ওই দুই ছাত্রকে নিয়মানুযায়ী বহিষ্কার করা হয়।
তবে এ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য তদবির করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমান। কিন্তু নিয়ম লঙ্ঘন করে ওই দুই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করায় বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলামকে পিটিয়েছেন মেয়রের লোকজন। মেয়র বাহিনীর হামলায় আহত হন প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলাম। শনিবার রাত ১১টার দিকে ঢাকা বাস টার্মিনাল এলাকায় অবস্থিত আরাফাত বোর্ডিংয়ে দলবল নিয়ে সেখানে হাজির হন মেয়র। সে সময় তার সঙ্গে অর্ধশত নেতাকর্মীও ছিলেন।
প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলাম অভিযোগ করেন, বহিষ্কৃত ওই দুই শিক্ষার্থীর পরিবার মেয়রের কাছে তাদের সন্তানদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করে। পৌর মেয়রের নির্দেশে ৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম ও ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামশুল হক মোবাইল ফোনে আমার কাছে অনুরোধ করেন এবং ওই দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ করেন।
গত শনিবার পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমান আমাকে ফোন করে ওই দুই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। কিন্তু আমি তাকে বলি, এটা করলে নিয়ম লঙ্ঘন হবে। তবে আপনি যখন বলছেন, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি দেখব। সে সময় মেয়র আমাকে উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমি কে বলছি, এটা কী জানেন। আমি যা বলছি, আপনি তা-ই করবেন। আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? জানতে চাইলে মেয়র আমাকে তার পার্কে ডাকেন। আমি যেতে না চাইলে আমি কোথায় আছি জানতে চান। এ সময় আমি আরাফাত বোর্ডিংয়ে আছি বলে জানাই।
কিছুক্ষণ পর সেখানে দলবল নিয়ে চলে আসেন মেয়র। মেয়রের সঙ্গে থাকা লোকজন আমাকে মারধর শুরু করেন। মেয়রও উত্তেজিত হয়ে আমাকে আঘাত করেন। মেয়রের নির্দেশেই ছাত্রলীগ নেতা ফয়সালসহ মেয়রের বাহিনী আমাকে মারধর করেছে। সে সময় আমি ভয়ে দুই ছাত্রের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার কথা বলেছি। তারপরও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হলে ‘কাল থেকে স্কুলে যাবি না’ বলে হুমকি দেন। আমি এখনও চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছি বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক আরও জানান, এ ঘটনায় তিনি এখন পর্যন্ত কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করলেও তিনি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামসুজ্জামান বাবুকে জানিয়েছেন। আলোচনাসাপেক্ষে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও বাউবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ উপ-আঞ্চলিক কার্যালয়ের সমন্বয়কারী শামসুজ্জামান বাবু জানান, প্রধান শিক্ষক মারধরের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। দাপ্তরিক কাজে ঢাকা থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এলাকায় গিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
এদিকে প্রধান শিক্ষক রোববার (১৬ অক্টোবর) বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকের সাথে বিষয়টি নিয়ে সভা করেছেন। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার প্রত্যাহার এবং মেয়রের তদবির ও প্রধান শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ ধরনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিচারের দাবিও জানান শিক্ষকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল জানান, মারধরের পর তিনি সেখানে উপস্থিত হন এবং সেখানে উত্তেজিত অবস্থা বিরাজ করছিল। পরে সেখান থেকে সবাইকে সরে যেতে বলি এবং প্রধান শিক্ষক যাতে আবার লাঞ্ছিত না হন, সেজন্য লোক মারফত তাকে বাসায় পৌঁছে দিই। এ সময় পৌর মেয়রসহ সেখানে তার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরও বলেন, প্রধান শিক্ষক এ বিষয়ে অভিযোগ করলে দলীয়ভাবে মেয়রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের আরাফাত বোর্ডিংয়ে আসেন মেয়র মোখলেসুর রহমান। এসে মেয়রই প্রথম প্রধান শিক্ষক সামিউল ইসলামকে মারধর শুরু করেন। পরে তাকে অফিসে ঢুকিয়ে আরেক দফা মারধর করা হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।
তবে শিক্ষককে মারধরের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পৌরসভার মেয়র মোখলেসুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের জানান, কেউ অভিযোগ করলেই তো সত্য হয়ে যায় না। এমন ঘটনায় আমি জড়িত নই।
এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদ জানান, প্রধান শিক্ষককে মারধরের বিষয়টি আমি শুনেছি। প্রধান শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন। তবে প্রত্যেকেরই এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত। যদিও এখন পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ এ বিষয়ে জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানায়নি। তবে জানানো উচিত ছিল। তিনি এও জানান, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।