নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথায় কী ঘটে কী জানি।
চড়িত না গাড়ি, কী জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি।
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ রেলে ‘কলিসন’ হয়।
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।
তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল নন্দলাল।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’ একটি রম্য কবিতা হলেও, এখন কবিতার মধ্যে বাস্তবতা খুঁজে পাই। নন্দলালের মতো বাহিরে যেতে প্রচুর ভয় হয় এখন। গাড়িতে চড়ার কথা না হয় বাদই দিলাম, রাস্তাই চলাচলা করলেও একটা ভয় মনের মধ্যে সবসময় কাজ করে। হয় গাড়ির নিচে পৃষ্ট হবো, না হয় কোনো নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে পড়া কিছু একটার নিচে চাপা পড়ব। কয়েকদিন আগের কথায় বলা যাক মহাসড়কে নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের গার্ডার ভেঙে শিশুসহ একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু হলো। তারা কি এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর আশা করে বাহির হয়েছিল? তারা কি জানত এভাবে তাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে?
নন্দলালের মতো বাড়ির ভেতরে থাকলে তারাও হয়তো বাঁচতে পারত। কিন্তু জীবন তো আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’-এর মতো না। কয়েক বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনার কিছুতেই লাগাম পারানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সড়কে ঝড়ছে অকাল প্রাণ। কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই এখন নিরাপদ না, হোক সেটা নৌ, রেল বা স্থল। প্রায় সময় চালকদের অসাবধানতায় ঢুবে যাচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ, উল্টে যাচ্ছে বাস-ট্রাক। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন।
চলতি বছরে ৮ মাসেই সড়ক দুর্ঘটনা নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৮৫ জন। যার মধ্যে জুলাই ও আগস্ট মাসে মারা গেছে যথাক্রমে প্রায় ৭৩৯ ও ৫১৯ জনেরও বেশি।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানো এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন। বাস্তবেও তাই দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির চালক হয় অদক্ষ, না হয় নেই তাদের ভারী যানবাহন চালানোর কোনো লাইসেন্স।
আর তাদের যে লাইসেন্স নেই, তা জানা যায় কেবল যদি উক্ত চালকের দ্বারা কোনো দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়।
আমরা প্রশ্ন করতেই পারি, দক্ষ লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানোর অনুমতি তারা কোথায় পায়? প্রশাসনের কি কোনো দায় ভার নেই? শুধু অদক্ষ চালক নয়, সড়কে চলাচল করা ফিটনেসবিহীন গাড়িরও দুর্ঘটনার জন্য কম দায়ী নয়। দেশে অন্তত ৫ লাখের বেশি ফিটনেসবিহীন গাড়ি রোডে অবাধে চলছে।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাও অনেকটা দায়ী। কারণ তারা কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কর্মকর্তারা চেয়ারে বসে বসে কাজের কাজ না করে গলাবাজি করতে পারেন। প্রায় সময় দেখা যায় রাস্তায় বাস-ট্রাক নিজেদের লাইন থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে উল্টোপথে ঢুকে পরে ছোট ছোট গাড়িগুলোকে পিষে ফেলে, সেসব যানবাহরের যাত্রীদের প্রাণ কেড়ে নেয়। এমন কয়টি ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে? কয়জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে?
২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলরের পর সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেতে বেশ কিছু আইন করা হলেও তা কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বিআরটির পেশাদার লাইসেন্সে করার ন্যূনতম যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি ও বয়স ২১ হলেও বেশিরভাগ চালক কিশোর। মহাসড়কে দূরপাল্লার গাড়িগুলো মেতে উঠে প্রতিযোগিতায়।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ঢালাওভাবে কর্র্তৃপক্ষকে দায়ী করাও উচিত হবে না। এক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু দায়বদ্ধতা আছে, আমরাও নিজেরাও তেমন সচেতন না, মহাসড়কগুলোতে এসে আমরা ব্যস্ত হয়ে পরি, বড় বড় হাওয়াতে ওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও প্রায় সময় দেখা যায় আমরা তা ব্যবহার না করে মহাসড়কের মাঝখান দিয়ে রাস্তা পার হই।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে প্রয়োজন কার্যকরী আইনি ব্যবস্থা ও তার সঠিক প্রয়োগ। আর যেন সড়কে অকালপ্রাণ না যায়, তাই আমাদের চাওয়া। আমরা চাই নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ওমর ফারুক
শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ
শহিদ স্মৃতি সরকারি কলেজ
মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ