Print Date & Time : 14 September 2025 Sunday 5:25 pm

চাকরিতে আবেদন ফি বৃদ্ধি ও বেকারদের দুঃখগাথা

আমাদের দেশে বয়সভেদে নানা শ্রেণির মানুষ রয়েছে। প্রায় সবাই কোনো না- কোনোভাবে মানুষের কাছে মূল্যায়িত হয়। তবে একশ্রেণির মানুষ আছে আমাদের দেশে যাদের কেউ মূল্যায়ন করে না। তারা অনেকটা ফুটবলের মতো। যে যেভাবে যে অবস্থায় পায়, সেভাবেই লাথি মারে! আর ফুটবলের মতো দিগবিদিক ছুটে যায় এ মানুষ। আমার মনে হয়, কাদের কথা বলছি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন। আমি বলছি, আমার দেশের হতভাগা বেকারদের কথা। এ সমাজ এ রাষ্ট্র বেকারদের কথা কখনোই ভাবে না। তাদের দুঃখের, কষ্টের কথা শোনার মতো কেউ নেই! আমাদের দেশের বেকাররা অনেকটা মাঝিবিহীন নৌকার মতো, নদীর মাঝখানে গিয়ে শুধুই ভাসতে থাকে। তবে কূলকিনারা পায় না খুব সহজে। আর এভাবেই ভাসতে ভাসতে হাজার হাজার বেকার যুবক হারিয়ে যায় নদীর অতল গহ্বরে।

গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হয় হাজারো হতাশার গল্প। চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যার গল্প। কারণ এই সমাজে শুধু সফল যুবকদেরই মূল্যায়ন করা হয়। ছুড়ে ফেলা হয় ব্যর্থ যুবকদের যারা কখনও চাকরি নামক সোনার হরিণের মুখ দেখেনি। এমনিতেই চাকরি না পাওয়াই হতাশায় থাকে প্রায় বেশিরভাগ যুবক। এর মধ্যে অধিকাংশ তরুণের থাকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, যার ফলে সে ঠিকমতো চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারে না। কারণ চাকরিতে আবেদন করতে এদেশে প্রচুর টাকা খরচ হয়। তাছাড়া মেসে থাকা, খাওয়া, যাতায়াত ও বইখাতা কেনার জন্য খরচতো রয়েছেই। এত খরচ থাকা সত্ত্বেও টিউশনি ছাড়া বেকারদের আর কোনো ভরসাস্থল নেই বললেই চলে!

ঠিক এরকম অবস্থায় বেকারদের সঙ্গে বড় ধরনের তামাশা শুরু হয়েছে আবার। সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিতে আবেদন ফি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেখানে নবম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব চাকরিতে আবেদনের জন্য ৬০০ টাকা ধার্য করা হয়েছে যেটি আগে ছিল ৫০০ টাকা। দশম গ্রেডের চাকরিতে আবেদনের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা, যেখানে আগে ৩০০ অথবা ৪০০ টাকাতে আবেদন করা যেত। ১১তম ও ১২তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০০ টাকা, যেখানে আগে আবেদন করা যেত ২০০ টাকা দিয়ে। ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা, যেখানে সাধারণত ১৫০ বা ১২০ টাকায় আবেদন করা যেত। আর সর্বশেষ ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের আবেদন ফি নির্ধারিত হয়েছে ১০০ টাকা। এই গ্রেডগুলোতে আগে আবেদন করা যেত মাত্র ৫৬ টাকা বা ১১২ টাকা দিয়ে। 

এভাবে আবেদন ফি বাড়ানোর ফলে বেকারদের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়ে হতাশার পরিমাণ বাড়বে। আত্মহত্যার পরিমাণও বাড়বে। তখন এর দায় কে নেবে? যেখানে কর্তৃপক্ষের উচিত আবেদন ফি কমিয়ে একদম সীমিত করে ফেলা, সেখানে এভাবে চাল-ডালের মূল্য নির্ধারণের মতো আবেদনের ফি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা বেকারদের সঙ্গে এক ধরনের তামাশার স্বরূপ। এটাতো গেল সরকার নির্ধারিত চাকরির ফি। দেশে বহু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে একটি আবেদন করতে কমপক্ষে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা গুনতে হয়। শুধু কি আবেদন করলেই খরচের পর্ব শেষ হয় বেকারদের? না শুধু আবেদন করেই খরচের পর্ব শেষ হয়ে যায় না বেকারদের। কারণ আবেদন করলে পরীক্ষা দিতে যেতে হয় ঢাকাতে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য মতে, বছরে প্রায় ২ কোটি চাকরিপ্রত্যাশী চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ লাখ ঢাকায় থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। আর বাকিরা উপজেলা কিংবা জেলা শহর থেকে এসে পরীক্ষা দেন। যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া বাবদ আরও অন্ততপক্ষে ২০০০ টাকা খরচ হয়।

এছাড়া চাকরির পরীক্ষা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই। দেখা যায়, আবেদন করার তিন বছর পর পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় যেটা বেকারদের জীবনে এক ধরনের অভিশাপস্বরূপ। সাম্প্রতিককালে এমনও ঘটনা দেখা গেছে, আট বছর পর চাকরির পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রার্থীদের প্রবেশপত্র পাঠানো হয়েছে। এটি যেমন নিন্দনীয় কাজ তেমনি বেকারদের সঙ্গে তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বেকারদের টাকাগুলোকে নষ্ট করারও এক ধরনের ফন্দি বটে।

বেকারদের পকেট থেকে যত বেশি খরচ হবে, তত বেশি মানসিক চাপ বাড়বে তাদের ওপর। ফলে খুব সহজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে আমাদের তরুণ সমাজ। আর আমরা হারিয়ে ফেলব জাতির সবচেয়ে মূল্যবান মানবসম্পদকে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, ‘…চাকরি প্রার্থী তরুণদের পরীক্ষার ফি ও তাতে অংশ নিতে অনেক খরচ হয়ে যায়। তাই নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজনের খরচের বেশি টাকা তরুণদের কাছ থেকে নেয়া অন্যায়।’ তার কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাইÑসময় এসেছে তরুণ বেকারদের কষ্টের কথা চিন্তা করে চাকরিতে আবেদন ফি কমিয়ে ভোগান্তি লাঘব করা। যাতে করে তরুণরাও সত্যিকার অর্থে এই দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য কাজ করার প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। চাকরিতে আবেদনের ফি কমানো গেলে লাখো বেকার যুবক-যুবতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে! তাদের দেহে প্রাণ ফিরবে। তাই চাকরিতে আবেদনের ফি না বাড়িয়ে বরং কমিয়ে দেয়ার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সেগুলো খুব দ্রুত গ্রহণ করা। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের ব্যাংকে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে। ব্যাংকে আবেদন ফি যেমন কম তেমনিভাবে গুচ্ছ পরীক্ষার জন্য খরচে অনেকাংশে কমে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে কোনো টাকাই লাগে না। আমাদের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুসরণ করে চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণ করতে পারে। চাকরিতে আবেদন ফি নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক হোক মূল আদর্শ, বেকাররা হাঁফ ছেড়ে বাঁচুক।

মো. বিল্লাল হোসেন

কলামিস্ট ও ফ্রিল্যান্স ফিচার লেখক

billalanftiu@gmail.com