চাকরি নয়, উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হবে তরুণদের

মাজহারুল ইসলাম সৈকত: সব তরুণ শিক্ষার্থীর সুন্দর ক্যারিয়ার প্রত্যাশা করা উচিত। বর্তমানে বেশিরভাগ তরুণ শিক্ষার্থীরা মনে করেন ক্যারিয়ার ভাবনা মানেই সরকারি চাকরি করা, বিসিএস ক্যাডার হওয়া অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়াকে বোঝায়। আসলেই কি তা-ই?

ক্যারিয়ার প্রত্যাশা মানে এই নয় যে, তাকে সরকারি চাকরিজীবী বা বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। বর্তমানে বেশিরভাগ তরুণ ক্যারিয়ার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, কারণ তারা জানে না ক্যারিয়ার চয়েস কখন কীভাবে করতে হয়। শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তাভাবনার জন্য মূলত ৩টি স্তর থাকে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যারিয়ার ভাবনা।

প্রাথমিক স্তরের ক্যারিয়ার ভাবনা বলতে একজন শিক্ষার্থী নি¤œ মাধ্যমিক শেষ করার পর অর্থাৎ জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার পর যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। এই পর্যায়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর পরিবার ও শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন, সে ভবিষ্যতে কী হতে চায়? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নাকি সাধারণ বিভাগের কিছু? সে অনুযায়ী তাকে বিভাগ পছন্দ করতে হয়। তাই আমার মনে হয় ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার প্রাথমিক স্তর মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ালেখার শুরুতে। দ্বিতীয় স্তরের ক্যারিয়ার চিন্তা শুরু করতে হয় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর, যখন একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হয় যা মাধ্যমিক স্তর হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ক্যারিয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এই স্তরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যারিয়ার চিন্তার ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষকের মতামত বেশি প্রাধান্য পেলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে ক্যারিয়ার চিন্তা শুরু করতে পারে। তৃতীয় স্তরের ক্যারিয়ার ভাবনা আমার মতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চলাকালীনই শুরু করতে হয়, যা চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যারিয়ার চিন্তা বলে আমার মনে হয়। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই স্তরে এসে ক্যারিয়ার চিন্তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। বর্তমানে অনার্স-মাস্টার্স করে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেকার হয়ে পড়েছে শুধু এই চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যারিয়ার চিন্তা সঠিক সময়ে না করার কারণে।

এখন প্রশ্ন এই স্তরে শিক্ষার্থীদের কী কী বিষয় নিয়ে চিন্তা করা উচিত আর কী কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ? প্রথমত, একজন শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা করে ঠিকি কিন্তু ওই বিষয় নিয়েই পরে থাকলে আপনি ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞান অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রাখা উচিত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভালো ফলাফল পেতে চাইলে অবশ্যই অনুসন্ধানী বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে জ্ঞানী করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তির বিশ্বে টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রযুক্তি জ্ঞান রাখা আবশ্যক। বিভিন্ন ট্রেনিং সেশনে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থী নিজেকে প্রযুক্তিদক্ষ করে তৈরি করা উচিত। কম্পিউটার দক্ষতা অর্জন যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক করা উচিত। তৃতীয়ত, নিজেকে যাচাই করার মন-মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তার জন্য আপনাকে যাচাইমূলক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্যারিয়ার অলিম্পিয়াডের মতো বড় প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে। যেখানে যুক্ত হয়ে আপনি নিজেকে যেমন যাচাই করতে পারবেন, একই সঙ্গে দক্ষ ক্যারিয়ার গঠনে সহায়ক সমাধান পাবেন। এমন শিক্ষামূলক প্ল্যাটফর্মগুলো বাছাই করে নিজেকে যাচাইয়ের সুযোগ নিতে পারেন। চতুর্থত, বর্তমান প্রতিযোগিতাশীল বিশ্বে নিজেকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে আপনাকে আরও বেশ কিছু দিকে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে যেমন কমিউনিকেশন দক্ষতা বাড়ানো, নেতৃত্ব দেয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি, মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা, হাল না ছাড়ার দক্ষতাসহ আরও ভিন্নধর্মী বিভিন্ন কৌশল শিখে নিতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন প্রচেষ্টা আর উদ্যম। পঞ্চমত, বর্তমানে বেশিরভাগ তরুণ শিক্ষার্থীই মনে করে থাকেন সরকারি চাকরি আর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই ক্যারিয়ার গঠন হয়ে যায়। সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা, হ্যাঁ সরকারি চাকরি আর বিসিএস ক্যাডার হওয়া ক্যারিয়ার গঠনের অনেকগুলো অপশনের মধ্যে একটি, অবশ্যই ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত। তার মানে এই নয় যে, ক্যাডার হতেই হবে এটাই একমাত্র লক্ষ্য। ষষ্ঠত, উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। একজন শিক্ষার্থী সায়েন্স নিয়ে পড়ালেখা করেছে বলে সে উদ্যোক্তা হতে পারবে না কিংবা আর্টস নিয়ে পড়ালেখা করেছে বলে বিজনেসম্যান হতে পারবে না ব্যাপারটা এমন নয়। যেকোনো বিষয় নিয়ে পড়ে আপনি একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন। বর্তামান বিশ্ব শিল্পবিপ্লবের যুগে এসে শিক্ষার্থীরা শিল্প উদ্যোক্তা হবে বা ব্যবসায়ী হবে এমন চিন্তা করতে পারলে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট পাওয়া যাবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে উদ্যোক্তা হওয়ার বিকল্প নেই। আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার ভাবনায় উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছা প্রথমে রাখতে হবে

সর্বশেষে বলা যায়, লক্ষ্যহীন নৌকা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। জীবনের মোড়ে মোড়ে আপনার লক্ষ্য পরিবর্তন হতেই পারে, তবে পরিবর্তিত লক্ষ্য আগের লক্ষ্য থেকে উচ্চ হতে হবে। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার ভাবনা ভাবা দরকার। ক্যারিয়ার ভাবনায় আপনাকে শতভাগ সফল হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, আপনি যখন একটি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাবেন আপনার উদ্দেশ্যই থাকবে সফল হওয়া আর এই সফল হওয়ার প্রবল ইচ্ছাই আপনার ভবিষ্যৎকে সফলতায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেবে। সময়মতো ক্যারিয়ার চিন্তা না করার কারণে আজ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার ব্যর্থতায় রূপ নিচ্ছে। আপনার দক্ষতাই আপনার ক্যারিয়ারÑ এই কথা মাথায় রেখে আপনি নিজেকে দক্ষ করে তুলতে না পারলে আফসোস করতে হবে।

পরশুরাম, ফেনী