চার অপারেটরের রাজস্ব ফাঁকি ৮৮৩ কোটি টাকা

 

মাসুম বিল্লাহ: সিম রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন সিম বিক্রি করায় চারটি মোবাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে ৮৮৩ কোটি টাকার সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। এ রাজস্ব পরিশোধে দাবিনামা জারি করে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় পাঠানো হয়েছে। গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনস্থ বৃহৎ করদাতা ইউনিট, মূসক (এলটিইউ-ভ্যাট) পৃথক চারটি চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে। কোম্পানি চারটি হলো গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি আজিয়াটা ও এয়ারটেল বাংলাদেশ।

সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটরগুলো রিপ্লেসমেন্ট সিমের আদলে নতুন সিমকার্ড বিক্রির মাধ্যমে কম রাজস্ব পরিশোধ করছে কি না তা যাচাই-বাছাই করতে এলটিইউ-ভ্যাটের অতিরিক্ত কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বিটিআরসি ও মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। এ কমিটি ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত দাখিলপত্রে জমা দেওয়া গ্রামীণফোন, রবি, এয়ারটেল ও বাংলালিংকের রিপ্লেসমেন্ট সিমের তথ্য যাচাই শুরু করে। এ কাজে সহযোগিতার জন্য সিম রিপ্লেসমেন্টের মাসভিত্তিক প্রমাণপত্র উপস্থাপনের অনুরোধ জানানো হলেও মোবাইল অপারেটর ও অ্যামটব একই বিষয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে বলে জানায়। পরে সমনথির মাধ্যমে আবার সিম রিপ্লেসমেন্টের তথ্য চাওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে কোনো অপারেটরই জমা দেয়নি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দাখিলপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে সিম রিপ্লেসমেন্টের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। শুনানির দিনক্ষণ ঠিক করার পরও মোবাইল অপারেটরগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত হননি। তাই রাজস্ব পরিশোধে গতকাল সোমবার চারটি মোবাইল অপারেটরের ঠিকানায় চূড়ান্ত দাবিনামা পাঠানো হয়েছে।

বেসরকারি সেলফোন অপারেটরদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) সাধারণ সম্পাদক নূরুল কবির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সিম রিপ্লেসমেন্টের বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বিষয়ে এলটিইউয়ের দাবির কারণে এ খাতের বিনিয়োগকারীরা নেতিবাচক বার্তা পাবেন। এতে সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ওপর বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে। এ খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে আসবে। এ কারণে সরকারের সহায়তায় ফোরজি চালুর পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’

অপারেটরগুলোর মধ্যে ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত ভ্যাট কার্যালয়ে জমা দেওয়া দাখিলপত্রে এক কোটি ছয় লাখ তিন হাজার ৩৫৮টি সিম রিপ্লেসমেন্টের তথ্য উল্লেখ করে গ্রামীণফোন। এসব সিমের বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক বাবদ ২৪০ কোটি টাকা এবং ভ্যাট বাবদ ১৩৮ কোটি টাকাসহ সর্বমোট ৩৭৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করতে দাবিনামা জারি করা হয়েছে।

একই সময়ে বাংলালিংক ৪৫ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৭টি সিম রিপ্লেসমেন্ট করে। একই হিসেবে এ কোম্পানির কাছে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ পাওনা দাঁড়িয়েছে ১৬৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে তাদের অনুরোধ করা হয়েছে।

বাংলালিংকের করপোরেট কমিউনিকেশন্স ম্যানেজার অংকিত সুরেকা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সিম ট্যাক্স নিয়ে কোনো চিঠি বা দাবিনামা এসেছে কি না, এ বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। খোঁজ নিয়ে পরে জানাতে পারব।’

রবি আজিয়াটা ওই সময়ে ৭৫ লাখ ২৫ হাজার ৭৬৩টি সিম রিপ্লেসমেন্ট করে। হিসাব অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ কোম্পানিকে ২৮৫ কোটি ২০ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে এয়ারটেল ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৬টি সিম রিপ্লেসমেন্ট করে। একই হিসেবে এ কোম্পানিকে ৫০ কোটি ২৬ লাখ টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রিপ্লেসমেন্টের নামে নতুন সিম বিক্রির মাধ্যমে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে এলটিইউ’র দাবিনামার ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মতামত জানাতে চায়নি টেলিকম অপারেটর রবি আজিয়াটা ও এয়ারটেল। এ বিষয়ে জানতে তাদের পক্ষে জনসংযোগের দায়িত্বপালনকারী ইমপ্যাক্ট পিআর ও কোম্পানিটির দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ‘বিষয়গুলো পুরোনো, এসব নিয়ে আইনি প্রক্রিয়াও চলছে’ উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তারা।

নিয়ম অনুযায়ী, মোবাইল অপারেটরগুলোকে প্রতিটি নতুন সিম বিক্রিতে সরকারকে ১০০ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করতে হয়। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক ৬৩ টাকা এবং ভ্যাট ২৭ টাকা আছে। রিপ্লেসমেন্ট সিমে এ রাজস্ব দিতে হয় না।

সিম রিপ্লেসমেন্ট সংক্রান্ত ২০০৫ সালে জারি করা এনবিআরের এক ব্যাখ্যায় বলা আছে, মূল ক্রেতার সিম কার্ড হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মোবাইল নম্বর অপরিবর্তিত রেখে সিম কার্ড-রিম কার্ড প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে নতুনভাবে শুল্ককর দিতে হবে না। তবে মোবাইল অপারেটরগুলোকে এ ধরনের কার্ড বা পদ্ধতিগত প্রতিস্থাপনের তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রতিমাসে দাখিলপত্র জমার সময় এসব তথ্য সংযুক্ত করে ভ্যাট কার্যালয়ে জমা দিতে হবে।

এলটিইউ সূত্র জানায়, চূড়ান্ত দাবিনামা অনুযায়ী মোবাইল অপারেটরগুলো বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ ও আপিল করতে তিন মাস সময় পাবে। আপিল করতে হলে আগে বকেয়া রাজস্বের ১০ শতাংশ জমা দিতে হবে। যদি কোম্পানিগুলো রাজস্ব পরিশোধ বা আপিল না করে তাহলে আইনগত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হতে পারে।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০০৭ থেকে ২০১১ মেয়াদের সিম রিপ্লেসমেন্ট ইস্যুতে পাঁচটি মোবাইল অপারেটরের বিরুদ্ধে দুই হাজার ৪৮ কোটি টাকার দাবিনামা জারি করে এলটিইউ-ভ্যাট। বর্তমানে এটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে।