নিজস্ব প্রতিবেদক: পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানিতে ব্যবহার করা হয়েছে ভুয়া ইএক্সপি (এক্সপোর্ট পারমিশন) ও সেলস কন্ট্রাক্ট। এক-দুটি নয়, এক হাজার ৭৮০টি পণ্য চালান, এমন ভুয়া ইএক্সপি ও সেলস কন্ট্রাক্ট ব্যবহার করে রপ্তানি করা হয়েছে। জালিয়াতির এখানেই শেষ নয়। চক্রটি বিল অব এক্সপোর্টে ব্যবহার করেছে শুল্কমুক্ত সুবিধার কোড নাম্বার। জালিয়াতির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় এ বিপুল পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে দেশের চারটি প্রতিষ্ঠান। কাগজপত্র ভুয়া হলেও পণ্য ঠিকই রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু রপ্তানি হওয়া পণ্যের অর্থ দেশে আসেনি। এ রপ্তানির মাধ্যমে চারটি প্রতিষ্ঠান অন্তত ৩৭৮ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। চারটি প্রতিষ্ঠান হলোÑঢাকার দক্ষিণ খান এলাকার সাবিহা সাইকি ফ্যাশন, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন, উত্তরার ইলহাম ও কাকরাইল এলাকার এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশন। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রপ্তানিতে প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করেছে। জালিয়াতি করায় ফৌজদারি মামলা হবে। আর রপ্তানির অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত না হওয়ায় মানি লন্ডারিং মামলা হবে। এছাড়া এ রপ্তানির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
কাস্টমস গোয়েন্দার উপপরিচালক মো. শাকিল খন্দকার জানান, ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার এসএপিএল (ওসিএল) কনটেইনার ডিপোয় অভিযান পরিচালনা করে কাস্টমস গোয়েন্দা চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি দল। তথ্য ছিল সাবিহা সাকি ফ্যাশন ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু রপ্তানির অর্থ দেশে আসেনি। অভিযানে জালিয়াতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় এবং সেখান থেকে সাতটি ৪০ ফুট কনটেইনার আটক করা হয়। পরে কনটেইনার থেকে ১১৮ টন পণ্য জব্দ করা হয়, যাতে টি-শার্ট ও নারীদের পোশাক রপ্তানির ঘোষণা থাকলেও শিশুদের পোশাক, জিন্স প্যান্ট, শার্ট, লেগিন্স, শালসহ ঘোষণাবহির্ভূত অনেক পণ্য পাওয়া যায়। এ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। সাবিহা সাইকি ফ্যাশনের রপ্তানিতে অনিয়ম তদন্ত করতে গিয়ে আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানের একই অনিয়ম পায় তদন্ত দল।
সাবিহা সাইকি ফ্যাশনের তদন্তে দেখা গেছে, সাবিহা সাইকি ফ্যাশন বিভিন্ন সময় মোট ৮৬টি চালানের মাধ্যমে ৯৯৭ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে, যার মধ্যে রয়েছেÑমেনস ট্রাউজার, টি-শার্ট, বেবি সেট, ব্যাগ, পোলো শার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট ও হুডি। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে। এ পণ্যের রপ্তানি মূল্য ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২৭ ডলার বা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। রপ্তানিতে ব্যবহার করা ইএক্সপি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড ও ব্যাংক থেকে যাচাই করা হয়। ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, রপ্তানিকারক সাবিহা সাইকি অন্য রপ্তানিকারকের ইএক্সপি ব্যবহার করেছেন, যার কারণে রপ্তানির অর্থ দেশে আসেনি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৮৬টি বিল অব এক্সপোর্টে উল্লেখ করা ইএক্সপি এ প্রতিষ্ঠানের নামে নয়, ভিন্ন ভিন্ন আমদানিকারকের অনুকূলে ইস্যু করা। বিল অব এক্সপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি কোড-২০ ব্যবহার করেছে, যা শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য রপ্তানির কোড। জাল ইএক্সপি ব্যবহার করায় অ্যাসাইকুডাতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিন নম্বরের সঙ্গে অটো মিল হয়নি।
তদন্তে দেখা গেছে, এশিয়া ট্রেডিং করপোরেশনও সাবিহা সাইকির মতো একই কায়দায় ইএক্সপি জালিয়াতি করে বিভিন্ন সময় এক হাজার ৩৮২ চালানে ১৪ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে। আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে টি-শার্ট, টপস ও লেডিস ড্রেস। রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য দুই কোটি ৫৮ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ ডলার বা প্রায় ২৮২ কোটি টাকা। এশিয়া ট্রেডিংয়ের লিয়েন ব্যাংক ব্র্যাক ব্যাংক জানিয়েছে, এ প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের পর কোনো রপ্তানি করেনি।
তদন্তে দেখা গেছে, ইমু ট্রেডিং করপোরেশন ও ইলহাম একই কায়দায় ২৭৩টি চালানে দুই হাজার ৫২৩ মেট্রিকটন টি-শার্ট, ট্রাউজার, টপস সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও আরব আমিরাতে রপ্তানি করেছে। যার মূল্য ৬৫ লাখ ৪ হাজার ৯৩২ ডলার বা প্রায় ৬২ কোটি টাকা। ইলহাম বিভিন্ন সময় ৩৯টি চালানে ৬৬০ মেট্রিক টন টি-শার্ট, ট্যাংক টপ, লেডিস ড্রেস রপ্তানি হয়েছে। যার মূল্য ১৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪৮৫ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে, এ দুই প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানিতে ব্যবহƒত ইএক্সপি সোনালী ব্যাংক থেকে ইস্যু করা হয়নি। মো. শাকিল খন্দকার আরও জানিয়েছেন, চারটি প্রতিষ্ঠান জাল নথিপত্রে রপ্তানির আড়ালে ১৭৮০টি চালানের ১৮ হাজার ২৬৫ মেট্রিক টন পণ্য রপ্তানি করেছে। যার বিনিময় মূল্য ৩ কোটি ৭৮ লাখ ১৭ হাজার ১০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭৯ কোটি টাকা।
অপরদিকে এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার কাকরাইলে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কার্যালয়ে সংস্থার মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা একমাস তদন্ত করে মোট চারটি প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচারের তদন্ত পেয়েছি, যাতে পাচার হয়েছে প্রায় ৩৮০ কোটি টাকা। যখন কোনো জালিয়াত চক্র অর্থ পাচারের উদ্দেশ্য রপ্তানি করে, তখন তার উদ্দেশ্যই থাকে রপ্তানিমূল্য কোনোভাবেই দেশে আসবে না। সেক্ষেত্রে তারা পণ্যের মূল্য কোনো না কোনোভাবে কম দেখানোর (আন্ডার ইনভয়েসিং) চেষ্টা করে। তার প্রধান লক্ষ্যই হলো টাকা বিদেশে পাচার করা। সেক্ষেত্রে তারা পণ্য রপ্তানির কথা বললেও উদ্দেশ্য হলো পণ্যের বিপরীতে টাকা আর দেশে আসবে না। বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ পন্থায় দেশে প্রত্যাবাসিত হওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় মানি লন্ডারিং সংঘটিত হয়েছে।
তিনি বলেন, অতীতে এ ধরনের জালিয়াতি উৎঘাটিত হয়নি। ইএক্সপি জালিয়াতি করে রপ্তানির বিষয়টি প্রথমবার কাস্টমস গোয়েন্দা উদ্ঘাটন করেছে। বিল অব এক্সপোর্টে ‘ফিল্ড-২৪’ নামে একটি ঘর রয়েছে। জালিয়াতিতে চক্রটি এ কোড ব্যবহার করেছে। এ কোড সাধারণত বন্ডেড প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে। আবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির ক্ষেত্রে এ ঘরে বিভিন্ন কোড ব্যবহার করা হয়। চক্রটি বিভিন্ন জেনুইন রপ্তানিকারকের ইএক্সপি ব্যবহার করেছেন। ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছে, ইএক্সপিগুলো এ চারটি প্রতিষ্ঠানের নয়। আমরা অনুসন্ধান করছি যে সিস্টেমে কোনো ক্রুটি রয়েছে কি না। আবার দেখা যায়, জালিয়াত চক্র সিস্টেমের মধ্যে নানা ফাঁক-ফোঁকর বের করে। সেটিও আমরা অনুসন্ধান করছি। চারটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য রপ্তানির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। আমাদের কোনো কর্মকর্তা হোক বা অন্য কোনো এজন্সির কর্মকর্তা হোকÑসংশ্লিষ্টতা পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, এ রপ্তানিতে দুই ধরনের অপরাধ হয়েছে। একটি হলো ডকুমেন্ট জালিয়াতি। এখানে যে কর্মকর্তা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সই ব্যবহার করা হয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত নয়। সেটিও জাল করা হয়েছে। এ জালিয়াতির জন্য ফৌজদারি মামলা করা হবে। অপরটি অর্থপাচার। সেজন্য মানিলন্ডারিং মামলা হবে।