দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি-রফতানি হলেও এর কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগারটি পড়ে আছে মুমূর্ষু অবস্থায়। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত লোকবল, অভাব আছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের। এ ধরনের নানা অসংগতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব
সাইদ সবুজ, চট্টগ্রাম: উচ্চ আদালত ছয় মাসের সময় বেঁধে দিলেও গত চার বছরেও মানা হয়নি সে নির্দেশনা। দেশের সব স্থল ও সমুদ্রবন্দরের শুল্ক ভবন/কমিশনারেট ও এলসি স্টেশনগুলোয় রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন ও আধুনিকায়নের কথা থাকলেও এখনও বাস্তবায়ন হয়নি হাইকোর্টের নির্দেশনা। ফলে অনেক শুল্ক ভবন/কমিশনারেট চলছে রাসায়নিক পরীক্ষাগার ছাড়া। যে শুল্ক ভবন/কমিশনারেটগুলোয় রাসায়নিক পরীক্ষাগার আছে, সেগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন নেই কোনো সেন্ট্রাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, যার অধীনে দেশের সব কাস্টমস ল্যাবরেটরি পরিচালিত হবে এবং সেইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের নমুনা বিশ্লেষণের কাজও করবে।
দেশে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত ফলের প্রবেশ রোধ করতে জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের বিপরীতে ২০১০ সালের ১০ মে একটি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। এরপর ২০১৪ সালের জুলাইয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
এই রায়ে বলা হয়, আমদানি করা ফল পরীক্ষা করে দেশের বাজারে ছাড়ার জন্য ছয় মাসের মধ্যে সব স্থল ও সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক সব শুল্কভবন এবং এলসি স্টেশনে রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে। নির্দেশনা পেয়ে একই বছরের ৩ আগস্ট এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব শুল্ক ভবন এবং শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার বরাবর চিঠি পাঠায় এনবিআর। এতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকাসহ রাসায়নিক পরীক্ষকের পদ সৃষ্টির নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ নির্দেশনায় অত্যাধুনিক ল্যাব করতে কোনো বন্দরের শুল্কভবনে কী প্রয়োজন হবে, জনবল কত লাগতে পারে, তার একটি হিসাব চাওয়া হয়। এর পর প্রত্যেকটি শুল্কভবন থেকে এই হিসাব পাঠানো হয়েছে এনবিআরে। কিন্তু চার বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি সে সিদ্ধান্ত।
চট্টগ্রম কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশনার আগে থেকেও এনবিআরে বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে রাসায়নিক পরীক্ষাগার আধুনিকায়নের জন্য প্রস্তুত করা অরগানোগ্রামসহ একাধিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর এসব চিঠি পাঠানোর পরও কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি।
এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কাস্টমসের একটি কেমিক্যাল ল্যাব থাকলেও সেটি পড়ে আছে পুরোনো অবস্থায়। যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন না হওয়ায় জটিল মিশ্রণের পরিমাণগত বিশ্লেষণের জন্য ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষেত্রে ছুটতে হয় সায়েন্স ল্যাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। এ ছাড়া এ ল্যাবে তরল কোকেনসহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের পরিমাণগত বিশ্লেষণের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও লোকবল নেই।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি ২০১৮-১৯ বাজেট আলোচনায় বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সঠিক পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। অনেক নমুনা পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট আসে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের পরীক্ষাগারের সঙ্গে বুয়েট বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবের রিপোর্টের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না। এতে আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এটি যত দ্রুত সম্ভব আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন।’
তবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগারের ইনচার্জ মো. হানান বলেন, ‘আমাদের ল্যাবে সব যন্ত্রপাতি পুরোনো নয়। অনেক ভালো সরঞ্জামও আছে আমাদের কাছে। তাছাড়া আমাদের কাছে যে পরিমাণ রিএজেন্ট আছে তা অন্য ল্যাবে নেই। আমরা ওয়ার্ল্ড কাস্টমস ওরগানাইজেশনের (ডাব্লিউসিও) সম্পাদিত এক্সপ্লেনেটরি নোটের আলোকে রাসায়নিক পরীক্ষা করি, যা বহিঃল্যাব কখনও করে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের রিপোর্টে ভুল হওয়া আশঙ্কা নেই। এছাড়া আমাদের যে রকম বাধ্যবাধকতা আছে সেটাও তাদের নেই। অনেক সময় দেখা গেছে বহিঃল্যাবের রিপোর্ট আমদানিকারকের পক্ষে যায়, কারণ আমদানিকারকরা তাদের মতো করে রিপোর্ট করিয়ে নেয়। বহিঃল্যাবের রিপোর্টে ভুল পাওয়া গেছে, এমন অনেক প্রমাণ আছে আমাদের কাছে। আমরা প্রতিটি রিপোর্টে ডব্লিউসিও এক্সপ্লেনেটরি নোটের আলোকে ব্যাখা ও কারণ উল্লেখ করে থাকি।’
শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশনার পর থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মধ্যে একাধিক চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ বছর পেরোলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ফাইলপত্র পড়ে আছে বিভিন্ন দফতরের হিমাগারে। ২০১৬ সালের ১১ মে তৎকালীন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার হোসাইন আহমদ এ বিষয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির চার সদস্যের স্বাক্ষরিত অরগানোগ্রামসহ ২২১ পৃষ্ঠার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করে চিঠি পাঠানো হয় এনবিআরে। এছাড়া এস-৪/৫৪/প্রশাসন/রাসায়নিক পরীক্ষগার স্থাপন/২০১৫-১৬/৬০৬২(১) নথিতে বলা হয়, হাইকোর্টের পিটিশন নং ৪৪৯৬/২০১০-এর নির্দেশের আলোকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি আধুনিকায়নের জন্য এর আগে প্রস্তাবিত অরগানোগ্রাম ঞঙ ্ ঊ-তে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির তালিকা, রিএজেন্টের তালিকা, গ্লাসওয়্যারের তালিকা ও বইপত্রের তালিকা পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া ওই পত্রে এনবিআরের এর অওতাধীন একটি সেন্ট্রাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি স্থাপনের জন্য প্রস্তাবিত অরগানোগ্রাম পাঠানো হয়েছিল। উল্লেখ্য, ওয়ার্ল£ কাস্টমস অরগানাইজেশনের আওতাধীন প্রায় প্রতিটি দেশের কাস্টমস কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিগুলো একটি সেন্ট্রাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
এরপর এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে ০৮.০০.০০০০.০৩৮.২৮.০১০.১৭.১২৯ স্মারক নম্বরে ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি এবং ০৮.০১.০০০০.০১২.০১.০০৫.১৪-৬৩(১)নং সূত্রে এনবিআর থেকে আরেকটি পত্র আসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে। এরপর ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর পত্র নং এস-৪/৫৪/প্রশাসন/রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন/২০১৫-১৬/৫৪৫৯কাস সূত্রে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে এনবিআরে চিঠি পাঠানো হয়। তারপর আইআরডি থেকে ০৮.০০.০০০০.০৩৮.২৮.০১০.১৭.১২৯ স্মারক নম্বরে ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর আবার চিঠি আসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে। ওই চিঠিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ খোদ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকেই দায়ী করে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বলে, ওই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ গুরুত্ব দিচ্ছে না। এছাড়া চিঠিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানোর কথা বলা হয়। তবে ওই চিঠির উত্তরে ‘রাজস্ব খাতে পদ সৃজনের প্রস্তাব প্রেরণের ছক’ এবং ‘রাজস্ব খাতে যানবাহনের প্রস্তাব প্রেরণের নমুনা ছক’ তৈরি করা হলেও এখনও প্রেরণ করা হয়নি চট্টগ্রাম কাস্টমসের নানা জটিলতার কারণে।
জানা যায়, প্রস্তাবিত অরগানোগ্রাম খোদ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কর্তাদেরই পছন্দ হয়নি। প্রস্তাবিত অরগানোগ্রামে যে পদগুলো রাখা হয়েছে সেখানেই সমস্যা। কারণ আগের অরগানোগ্রামে রাসায়নিক পরীক্ষাগার পরিচালিত হতো যুগ্ম কমিশনারের অধীনে। বর্তমান অরগানোগ্রাম অনুসারে রাসায়নিক পরীক্ষাগার পরিচালিত হবে সরাসরি কমিশনারের অধীনে। তাই অরগানোগ্রাম আবার সংশোধনের অজুহাতে দীর্ঘদিন ফাইলপত্র পড়ে আছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের টেবিলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে পদের যে কথাটা বলা হচ্ছে, সেটা দুটো ভিন্ন বিষয়। একটি সেন্ট্রাল কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি অন্যটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ল্যাবরেটরি। একটার সঙ্গে অন্যটার তুলনা করলে তো হবে না। তাছাড়া রাসায়নিক পরীক্ষকের পদটি তো আগে থেকেই যুগ্ম কমিশনারের সমমানের করে অনুমোদিত হয়ে আছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বেশ কয়েকবার চিঠি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠানো হলেও রাজস্ব বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সরাসরি চট্টগ্রাম কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে সর্ষের ভেতর ভূত থাকায় কোনো কাজ হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রাসায়নিক পরীক্ষাগার আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এ বিষয়ে প্রস্তাবিত অরগানোগ্রামসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হবে। আশা করি খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে। এছাড়া এখানে পুরোপুরি এনবিআর দায়ী নয়। এই কাজগুলো সম্পাদন হতে অনেক মন্ত্রণালয় ঘোরে। যেমন জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ও আছে। বলা যেতে পারে সমন্বয়ের অভাব। তাই কাজ হতে সময় লাগছে।’