ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে দেশে বর্ধিত দামে মোটা চাল বিক্রি হয় ৩৬ টাকায়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণেই রাখে চালের দাম। সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা দরে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে দেশে। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমান বাজারে পণ্যটির দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ। গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত এক খবরে প্রতিবেদক জানিয়েছেন, প্রতি কেজি মোটা চাল এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বাজারে; মাঝারি ও চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫৬ টাকা প্রতি কেজি। সেদিক থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে মোটা চালের দর বেড়েছে কমপক্ষে ৪২ শতাংশ! কথা হলো, হঠাৎ চালের দাম এভাবে বাড়লো কেন? তার কারণ বাহ্যত প্রাকৃতিক। প্রথমত, চলতি বছর আগাম বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি হয়েছে হাওর অঞ্চলের ৭টি জেলায়। দ্বিতীয়ত, ১৯টি জেলার কমপক্ষে ১০ লাখ টনের বেশি বোরো উৎপাদন নষ্ট হয়েছে ছত্রাকের আক্রমণে। অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, এসব প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে মানবসৃষ্ট যে কারণটি যুক্ত হয়েছে সেটি হলো, একশ্রেণির চাল ব্যবসায়ীর অতিলোভ। তাদের ধারণা, এ বছর চালের দাম এত বাড়তো না, যদি বেসরকারি খাতের চালের বাজার যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। সেটি না হওয়ায় চালের দাম এমন বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ বিশেষত নি¤œবিত্ত ও নি¤œ-মধ্যবিত্ত আয়ের লোকজনের কষ্ট যেমন বেড়েছে, তেমনি ভিন্ন আরেকটি কারণে সরকারকে ভাবিয়েও তুলেছে বিষয়টি। তা হলো, দেশের সরকারি শস্যভাণ্ডারগুলোয় (গোডাউন) বর্তমানে মজুত রয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টন চাল, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। তদুপরি গত বছর ১০ লাখ ২১ হাজার টনের বেশি বোরো সংগ্রহ করেছিল সরকার; এখন পর্যন্ত এবারের সংখ্যাটি নাকি মাত্র ২৫ হাজার টন!
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেটিকে সময়োচিত বলতে হয়। আমরা প্রত্যাশা করি, পদক্ষেপটি ফলপ্রসূ হোক এবং তা চালের বাজার বশে আনতে সহায়তা জোগাক। খেয়াল করা দরকার, মোটা চালের দাম বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে বটে; কিন্তু তা জীবনযাত্রার ওপর আগের মতো প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কারো কারো মনে। কেননা এরই মধ্যে স্থানীয় নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতাও তো বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ফলে চালের দাম বৃদ্ধি ইস্যুকে ঘিরে ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ানোর তেমন শঙ্কা নেই বলে অনেকের মত। তবু সার্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার স্বার্থেই দ্রুত চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন। সেজন্য আমদানি অবশ্যই ভালো কৌশল বলে বিবেচিত হতো, যদি আন্তর্জাতিক বাজারে চাল রফতানিকারক দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাজারে গত এক বছরে চালের দাম না বাড়তো। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিকৃত বাড়তি দামের চাল স্থানীয় বাজারে কাক্সিক্ষত ফল এনে দিতে পারবে কি নাÑতা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। ফলে আমদানি কৌশল অব্যাহত রাখার পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের প্রতিও নজরদারি বাড়ানো চাই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোনো কোনো চাল ব্যবসায়ী বলেছেন, চালের দাম বাড়তো এমন ‘দুর্ভাবনা’ তাদের ছিল, তবে কোনো ধরনের কারসাজি ছাড়া চালের দাম এত বাড়তে পারে কি না, সে বিষয়ে নিঃসন্দিহান নন তারা। অভিযোগটি খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য তেমন পরিস্থিতিতেও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা উচিত অন্তত এ বিবেচনায় যে, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আর সতর্কতার সঙ্গে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালের বাজার দ্রুতই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।