চা আমাদের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্প। এর ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৮ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ সালে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়। ১৮৫৪ সালে মতান্তরে ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।
স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু দুটি জেলায় চা আবাদ করা হতো সিলেট জেলার ‘সুরমা ভ্যালি’ ও চট্টগ্রামের ‘হালদা ভ্যালি’। পরবর্তী সময় সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছেÑলস্করপুর ভ্যালি, বালিশিরা ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি, নর্থ সিলেট ভ্যালি এবং হালদা হয়েছে চট্টগ্রাম ভ্যালি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসেবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভূমির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিত হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়ে। বঙ্গবন্ধু এ শিল্পকে টেকসই খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নানা উদ্যোগ নেন। চা-শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি দেয়ার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এ কার্যক্রম এখনও অব্যাহত আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন, যেমন বিনা মূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, শিশুযতœ কেন্দ্র, প্রাথমিক শিক্ষা ও রেশন প্রাপ্তির নিশ্চিয়তা।
স্বাধীনত-পরবর্তী সময় আমাদের রপ্তানি আয়ের বড় উৎস ছিল চা-শিল্প। বর্তমানে অন্য খাতের প্রসার বাড়লেও চা-শিল্প অতি সম্ভাবনাময়।
গতকাল শেয়ার বিজের খবরে জানা যায়, রপ্তানিপণ্যের তালিকা থেকে চা হারিয়ে যাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকে চা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আমাদের চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। এর পর থেকে ধীরে ধীরে চা রপ্তানি কমতে থাকে। মূলত দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়ণের কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ ভোগের পরিমাণ বেড়েছে। এ কারণে উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি বাড়ছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে স্থানীয় বাজারে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে। ফলে দেশীয় বাজারের সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে চায়ের চাহিদা বছরে ১০ কোটি কেজি।
চা রপ্তানির অতীত ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার রপ্তানি বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বৃহদায়তন বাগানের পাশাপাশি সমতলে ক্ষুদ্রায়তনে চা আবাদে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় রপ্তানিপণ্য তালিকা থেকে চা হারিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। এত দিন শুধু পাহাড়ি অঞ্চল, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও সিলেটে চা উৎপাদিত হতো। এখন দেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিহাটের সমতল ভূমিতেও চা উৎপাদিত হচ্ছে। এতে অন্য ফসল চাষে অনুপযোগী জমিতে চা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। বৈশ্বিক বাজার ধরতে হলে চায়ের মান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ব্র্যান্ডিং ও প্যাকেজিংও উন্নত করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চা উৎপাদনে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।