Print Date & Time : 6 September 2025 Saturday 8:40 pm

চা শিল্পের বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে

মো. আরাফাত রহমান : চা একাট চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতি, যার শুকানো পাতা থেকে তৈরি হয় জনপ্রিয় পানীয়। বাঙালির প্রতিটি ঘরে সকাল শুরু হয় ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা দিয়ে। চা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য, যা দীর্ঘকাল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে বিবেচিত। চা শিল্পে প্রায় দেড় লাখ লোক কর্মরত আছে। এটি বাংলাদেশে মূলত একটি কৃষিভিত্তিক রপ্তানিমুখী বহুবর্ষজীবী ফসল। প্রাকৃতিক পরিবেশে চা গাছ ক্ষুদ্র বৃক্ষ আকারে বেড়ে ওঠে, কিন্তু পরপর ছাঁটাই ও অন্যান্য পরিচর্যা, যেমনÑআগা কাটা, কুঁড়ি ভাঙা, সঠিক মাত্রায় পাতা-কুঁড়ি সংগ্রহ প্রভৃতি কারণে গাছের সাধারণ আকৃতির পরিবর্তন হয়।

চা গাছের তিনটি ধরন রয়েছেÑআসাম, চীনা ও ক্যামবোয়েড। সাম্প্রতিক শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি ভৌগোলিক অঞ্চল অনুযায়ী চাষকৃত চায়ের তিনটি জাত হলো আসাম, চীনা ও ইন্দোচীনা। প্রথম দুটি চিহ্নিত ভ্যারাইটি আর তৃতীয়টি দক্ষিণাঞ্চলীয় বা ক্যামবোয়েড জাত হিসেবে পরিচিত। এভাবে রয়েছে হালকা পাতা ও গাঢ় পাতার আসাম জাত, তেমনি মণিপুরীর মতো ভ্যারাইটিগুলো। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে উৎপন্ন চা গাছ বিমিশ্র। পাতার কোণ, অবস্থান, আকৃতি, রোমশতা ও বর্ণবৈচিত্র্যসহ নানা ধরনের চা গাছ দেখা যায়।

বাংলাদেশের চায়ের অধিকাংশ চারাই সংকর ও বিমিশ্র, আর সেগুলোর চারিত্রিক বৈশিদ্দও রয়েছে। বেশিরভাগ চা অবশ্য গাঢ় রঙের পাতার জাত। বাংলাদেশে চা চাষের সফল ও উৎপাদনশীল উন্নয়নে বনও একটি উপযোগী ভ‚মিকা রাখে। বাংলাদেশের রয়েছে আবহমান কালের প্রাকৃতিক বন ও রোপিত বনভূমি। এখানকার প্রাকৃতিক বনগুলো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধা-চিরহরিৎ ধরনের। বনাঞ্চলগুলো প্রধানত উচ্চভ‚মিতে এবং চা বাগানগুলোর অধিকাংশই উঁচুনিচু পাহাড় ও উপত্যকায় অবস্থিত।

বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে আসা বনাঞ্চলের বিপুল আবর্জনা প্রায়ই চা বাগানে জমা হয় বা আটকে পড়ে সেখানে যথেষ্ট পুষ্টি জোগায়। অধিকন্তু ঘন ও গভীর প্রাকৃতিক ও রোপিত বনাঞ্চল প্রস্বেদনের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ পানি ত্যাগ করার ফলে সেখানে উঁচু আর্দ্রতা বজায় থাকে। বনাঞ্চল বছরের বেশিরভাগ সময় অত্যধিক বৃষ্টিপাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে, যা চা উৎপাদনের জন্য খুবই জরুরি। পাহাড় ও উঁচু উপত্যকার ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রবল বাতাস ও ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বনাঞ্চল চা গাছকে রক্ষা করে।

সংগ্রহ করার পর চায়ের পাতা কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করা হয়। বাংলাদেশে কালো চা সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যাপক ব্যবহƒত পানীয়। চা তৈরির মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহ, প্রসেসিং, রোলিং, গাঁজন, শুকানো, সেঁকা, মানানুযায়ী পৃথক্করণ ও প্যাকিং। সংগৃহীত চা পাতা অর্থাৎ দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ির গুণাগুণের ওপর মানসম্পন্ন চা তৈরি বহুলাংশে নিভর্রশীল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৪ জুন থেকে ১৯৫৮ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন।

বঙ্গবন্ধু চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এবং পরবর্তীকালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে চা শিল্পের উন্নয়নে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। চা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান ও চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর যোগদানের তারিখকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চা শিল্পের ভ‚মিকা বিবেচনায় ৪ জুনকে ‘জাতীয় চা দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের উদ্যোগে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার’ সেøাগান নিয়ে ২০২১ সালের ৪ জুন  বর্ণাঢ্য আয়োজনে দেশের সব চা উৎপাদনকারী অঞ্চলে উদ্যাপিত হয় প্রথম জাতীয় চা দিবস।

বঙ্গবন্ধু চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকায় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত শূন্য দশমিক ৩৭১২ একর ভ‚মির ওপর চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ কাজ ত্বরান্বিত হয়। তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের ক্লোন চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন। চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এবং শ্রীমঙ্গলে ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তিনি ‘টি অ্যাক্ট, ১৯৫০’ সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেছিলেন, যা এখনও চালু রয়েছে।

১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ সালে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব-সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কুণ্ডদের বাগান নামে পরিচিত। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।

রবার্ট ব্রুস আসামের উঁচু অঞ্চলে চা গাছের সন্ধান পান। এরপর ১৮৫৫ সালে সিলেটের চাঁদখানি টিলায় দেশীয় জাতের চা গাছের সন্ধান মেলে। একই সময়ে খাসি ও জৈন্তা পাহাড়েও বন্য প্রজাতির চা গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামেও চা উৎপাদন শুরু হয়। এখানে চা উৎপাদনের জন্য চীন থেকে চারা আমদানি করা হয় এবং কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে উৎপাদিত চীনা প্রজাতির চা গাছ রোপণ করা হয়। প্রথম দিকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। কিন্তু উনিশ শতকের ষাটের দশকে ব্যাপক মন্দায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে চা বাগান প্রতিষ্ঠার তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলে চা শিল্প ধীরে ধীরে বড় বড় কোম্পানির আয়ত্তে চলে আসে।

ওই মন্দার পর সিলেটের চা শিল্পে জেমস ফিনলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে ক্ষুদ্র একটি দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণি চা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতিদ্ব›িদ্বতার মুখোমুখি হলেও বিদেশি কোম্পানিগুলোর আধিপত্য কখনই বিঘিœত হয়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু দুটি জেলায় চা আবাদ করা হতো; একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল, আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালি’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালিকে ছয়টি ভ্যালিতে ভাগ করা হয়েছে, যেগুলো যথাক্রমেÑলস্করপুর ভ্যালি, বালিশিরা ভ্যালি, মনু-দলই ভ্যালি, লংলা ভ্যালি ও নর্থ সিলেট ভ্যালি এবং হালদা ভ্যালিকে চট্টগ্রাম ভ্যালি করা হয়েছে?

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পকে টেকসই খাতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (বিটিআইএমসি)’ গঠন করে যুদ্ধোত্তর মালিকানাবিহীন/পরিত্যক্ত চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া যুদ্ধে বিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বাগানগুলোকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের কাছে আবার হস্তান্তর করেন।

তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় সরকার চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করে। ওই সার সরবরাহ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমিকল্যাণ নিশ্চিত করেন; যেমনÑবিনা মূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি। তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট  (বিটিআরআই) নামে পরিচিত।

বর্তমান বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপের কারণে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সালে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ সালে ৮৫ দশমিক ০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা হয়, ২০১৮ সালে ৮২ দশমিক ১২ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬ দশমিক শূন্য ৭ মিলিয়ন কেজি এবং ২০২০ সালে ৮৬ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা হয়। এছাড়া ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করা হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না বরং রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।

১৯৭০ সালে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল ১৫০টি, বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি। বর্তমানে দেশে দুটি চা নিলাম কেন্দ্র রয়েছেÑচট্টগ্রাম নিলাম কেন্দ্র ও শ্রীমঙ্গল নিলাম কেন্দ্র। এছাড়া ২০০২ সাল থেকে চা বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্রায়তন চা আবাদ শুরু হয়েছে এবং ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। এছাড়া সরকার বাংলাদেশ চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য ১১টি কর্মকৌশল অন্তর্ভুক্ত করে ‘উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে, যা ভবিষ্যতে দেশের চা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে কার্যকর ভ‚মিকা পালন করবে?

সহকারী কর্মকর্তা

ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়