চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সমৃদ্ধ হবে চা-শিল্প

আফরোজা নাইচ রীমা: উষ্ণ এক কাপ চায়ে আমাদের গল্পগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ওড়ে। কাদের হাতের উষ্ণতায়, কীভাবে সতেজ রাখে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির চা এ বিষয়ে আজ আলোচনা করব। 

তিন পুরুষ ধরে চা-বাগানে কাজ করছে ৪০ বছরের করিমার পরিবার। জন্মের পর থেকেই মৌলভীবাজারের করিমপুর চা-বাগানে বেড়ে ওঠা, চা-বাগানেই কাজ করিমার। ধারণা ছিল করিমার, হয়তো সারাজীবন কষ্ট করে পার করতে হবে তার। কোনো উপায় নেই অন্য কোনো কাজ করার। আর এসব কথাই ভাবে করিমার মতো চা-বাগানের হাজারো মানুষ। কিন্তু কষ্টে থাকা এ মানুষগুলোর জীবনমানের উন্নতি ঘটতে থাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০ উদ্যোগ আর ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়ায় এসে।

চা-শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে পাকিস্তান চা গবেষণা স্টেশন (পিটিআরএস) নামে স্থায়ী গবেষণা কার্যালয় স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রথমে বাংলাদেশ চা গবেষণা স্টেশন (বিটিআরএস) নামকরণ থেকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) হিসেবে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে উন্নীত করা হয়। 

২০২১ সালের ৪ জুন প্রথমবারের মতো পালিত হলো জাতীয় চা দিবস। প্রথমবারের মতো পালিত জাতীয় চা দিবসের সেøাগানÑ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, চা-শিল্পের প্রসার’। বাংলাদেশের চা-শিল্পের বিকাশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি ১৯৫৭-৫৮ সালে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ছিলেন চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান। স্বাধীন বাংলাদেশে চা-শ্রমিকদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এছাড়া বঙ্গবন্ধু টি অ্যাক্ট সংশোধনীর মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন, যা এখনও চালু রয়েছে।

চা-গাছের দুটি পাতা একটি কুঁড়ি থেকেই পান করা হয় সুপেয় চা। একসময় এই ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র দেশ সিলেটেই শুধু চা-বাগান ছিল, কিন্তু https://teaboard.portal.gov.bd–এর ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট চা-বাগানের সংখ্যা ২৫১টি। মৌলভী বাজারে ৯১টি, হবগিঞ্জে ২৫টি, চট্টগ্রামে ২১টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে আটটি, রাঙামাটিতে দুটি, ঠাকুরগাঁয়ে একটি চা-বাগান আছে। আমাদের দেশ বিশ্বের তিন শতাংশ চা উৎপাদন করে থাকে, যা ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ৯৬ দশমিক শূন্য সাত মিলিয়ন কেজি। লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী চা উৎপাদনে বিশ্বে নবম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানি হচ্ছে পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে।

চা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে চা-শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ২১টি উচ্চফলনশীল জাতের ক্লোন অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া খরাসহিষ্ণু ও উন্নত ফলনের আরও দুটি ক্লোনও অবমুক্ত করা হয়েছে।

চা-শিল্পের বর্তমান বয়স ১৭৮ বছর। সুদীর্ঘ পথচলায় চা-শিল্পের রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ইতিহাস। এর উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করা হয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ। প্রথম চা-বাগান করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৮২৮ সালে। বর্তমানে যেখানে চট্টগ্রাম ক্লাব, ১৮৪০ সালে সেখানেই প্রথম চা-গাছ রোপণ করা হয়। ১৮৫৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা আবাদ শুরু হয় সিলেটে। সে বছর সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনিছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত তখন থেকেই চা এদেশে একটি কৃষিশিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মূলত চা উৎপাদনে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের চা-শ্রমিক বলা হয়। চা-পাতা তোলার কাজে নারী শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। আর পুরুষ শ্রমিকরা সাধারণত বাগান রক্ষণাবেক্ষণ, চারা রোপণ, অফ সিজনে গাছ কাটা, বাগান পাহারা দেয়া, বেড়া দেয়া প্রভৃতি কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে।

চা-শিল্প  ও  নারী চা-শ্রমিক একে অপরের পরিপূরক। চা-শিল্পসংশ্লিষ্টদের ধারণা, চা-গাছ থেকে দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি উত্তোলনে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় নারী শ্রমিকরা অধিক দক্ষ ও কর্মঠ। তারা অনেক বেশি চা-গাছ থেকে কুঁড়ি উত্তোলন করতে সক্ষম। এজন্য নারী শ্রমিকরা চা-শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

বাংলাদেশে মূল বাগান ও ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট ২৫১টি চা-বাগানে মোট জনসংখ্যা সাত লক্ষাধিক। ২৫১টি চা-বাগানের মধ্যে ১৬৩টি মূল বাগান ও ৮৮টি ফাঁড়ি বাগান। যেসব চা-বাগানে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি রয়েছে, সেসব বাগানকে মূল বাগান এবং ফ্যাক্টরিবিহীন চা-বাগানগুলোকে ফাঁড়ি বাগান হিসেবে অভিহিত করা হয়। চা-বাগানের সাত লক্ষাধিক জনসংখ্যার মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক রয়েছে দেড় লক্ষাধিক। এর মধ্যে শুধু নারী শ্রমিকই রয়েছে প্রায় অর্ধ লাখ। অস্থায়ী ও স্থায়ী মিলিয়ে চা-শিল্পাঞ্চলে কর্মরত রয়েছেন কমপক্ষে আড়াই লক্ষাধিক শ্রমিক। এর মধ্যে স্থায়ী ও অস্থায়ী নারী শ্রমিক রয়েছেন লক্ষাধিক। এ নারী শ্রমিকদের মধ্যে আবার রয়েছে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটেগরির শ্রমিক। তাদের দৈনিক হাজিরা (বেতন) ক্যাটেগরি ভিত্তিতে পরিশোধ করা হয়। ‘এ’ ক্যাটেগরির একজন শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা হাজিরাপ্রাপ্ত হন। সপ্তাহে রোববার বাগানের কাজকর্ম বন্ধ থাকে। এ হিসাবে একজন চা শ্রমিকের সাপ্তাহিক হাজিরা মাত্র ৬১২ টাকা। মাস হিসাবে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৪৮ টাকা। এত অল্প বেতন নিয়ে চা-শ্রমিকদের সংসার পালন অত্যন্ত কষ্টকর হলেও নারী চা-শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চা-শিল্পের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অবদান রেখে চলেছেন।

জানা যায়, চা-শিল্পাঞ্চলে নিয়োজিত নারী চা-শ্রমিকরা প্রাত্যহিক কাজে বের হন সকাল ৯টার মধ্যে। চা-বাগানের শ্রমিক কলোনির জীর্ণ কুটির থেকে চা-পাতা চয়নের উদ্দেশ্যে সকাল ৯টার আগে বের হয়ে চা-বাগানের বিভিন্ন সেকশনে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চা-পাতা চয়ন করে থাকেন তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বৃষ্টি কোনো কিছুই তাদের কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে তারা প্রাত্যহিক কাজ করে থাকেন। প্রায় সাত ঘণ্টা চা-পাতা চয়নের মাঝে দুপুরে খাবারের জন্য ৩০ মিনিট ছুটি দেয়া হয় তাদের। এ সময় চা-বাগানের ছায়াদানকারী বৃক্ষের নিচে বসে তারা সেরে নেন দুপুরের খাবার। তাদের দুপুরের খাবারের তালিকায় বেশিরভাগ সময় থাকে আটা দিয়ে তৈরি শুকনো রুটি। এ ছাড়া কচি চা-পাতা, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ও লবণ দিয়ে তারা এক ধরনের ভর্তাজাতীয় খাবার তৈরি করে খেয়ে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চা সেকশনে চায়ের কচি পাতা উত্তোলন বা পাতা চয়নের পর চা-পাতাগুলো মাপার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সেকশনের পাতিঘরে। চা-পাতা মাপা শেষ হলে নারী চা-শ্রমিকরা টিলা বাবুর কাছে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে আসেন।

চা-বাগানে সরকারি সুবিধা অনেকটা পৌঁছেছে, আরও পৌঁছানো দরকার। চা-বাগানে নারীরা উপার্জন করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা এখনও অনেক পিছিয়ে। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের পঞ্চায়েত ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ নারীর ক্ষমতায়ন শতভাগ থাকলেও এখনও অনেক ঘাটতি আছে, তবে বর্তমান সরকার বিভিন্ন অধ্যাদেশ ও কার্যকলাপে এনেছে সময়োপযোগী পরিবর্তন।

১৯৬২ সালে যে চা-বাগান শ্রমিক অধ্যাদেশ জারি করা হয়, বর্তমানেও সেটি সংশোধন করার পর চালু রয়েছে। চা-শ্রমিকরা যাতে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন এবং কোনো ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার না হন, সেজন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ‘চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

২০১২ সালে চা-বাগানের শ্রমিকদের শতভাগ স্যানিটারির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে তা বিশুদ্ধ করে সেই পানি লাইনে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঝড়-তুফানের আশ্রয় নেয়ার জন্য দুটো করে শেল্টার করা হয়েছে বাগানে। পাকা সিঁড়ি করে দেয়া হয়েছে, যাতে ওঠানামা সহজ হয় এবং কর্মক্ষেত্রে যেতেও সময় কম লাগে ও সহজে যাওয়া যায়। 

সবুজের সমারোহে ছোট-বড় টিলায় থাকা চা-বাগানগুলোর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মতোই এখন সাজানো এখানকার শ্রমিকদের জীবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত আর বিশেষ পদক্ষেপের কারণে করোনার এই দুঃসময়েও

চা-শিল্পের অগ্রগতি লক্ষণীয়। উৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই বেড়েছে করোনাকালেও। চা-শ্রমিকদের জীবনেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বেড়েছে তাদের জীবনযাত্রার মান।

বিভিন্ন সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী করোনা মহামারিতে চা-বাগানের উৎপাদন অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেন। কারণ চা-গাছ থেকে প্রতিদিন পাতা না তুললে পাতা নষ্ট হয়ে যায়, গাছও বড় হয়ে যায়। সর্বোপরি পুরো বাগান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এক দিনের জন্যও চা-উৎপাদন বন্ধ থাকেনি। এর ফলে শিল্পের উৎপাদন যেমন ঠিক ছিল, তেমনি চা শ্রমিকরাও করোনায় কর্মসংস্থান হারাননি, সংকটে পড়েনি তাদের জীবনযাত্রা। অথচ একই সময়ে ভারতে প্রায় এক মাসের বেশি সময় চা উৎপাদন বন্ধ ছিল। আর চা উৎপাদন বন্ধ থাকায় সেখানে অনেক বাগান নষ্ট হয়ে গেছে, গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। চা-শ্রমিকদের ক্ষতি হয়েছে বিশাল।

ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত সেই গান ‘একটি কুঁড়ি দুটি পাতা, রতনপুর বাগিচায়’ সত্যিই বাস্তবায়নের পথে। আর তাই তো করিমার মতো হাজারো চা-শ্রমিক দেখতে পাচ্ছেন জীবনের নতুন আলো, জীবনের নতুন ধারা। মনভরে দেয়ার নানা স্বাদের চা, যার উন্নয়নে চা খাতে সরকারি বিনিয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চা-শ্রমিকদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কবলে যেন এ শিল্প না পড়ে, সে ব্যাপারে চা উৎপাদনকারী দেশগুলোকে দাতা দেশগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই চা-শ্রমিকদের হাসিমাখা ক্লান্ত দেহের শ্রম সার্থক করে এ শিল্প আরও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে নেবে দেশের অর্থনীতিকে। আর একই সঙ্গে চা-শ্রমিকদের জীবনের উন্নয়ন ধরা দেবে এবং তাদের সুখে সুখী হবে দেশ, হাসবে তাদের হাসির সঙ্গে।

পিআইডি নিবন্ধ