চীনা ঋণের গতিপ্রকৃতি: মালয়েশিয়ার পথে পাকিস্তান

ড. আর এম দেবনাথ:  পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটির ক্ষমতায় আসার পর বলেছেন, তার লক্ষ্য ‘নতুন পাকিস্তান’। নতুন পাকিস্তানের রূপরেখা কী, তা আমরা কেউ জানি না। তবে দৃশ্যত দেশের ভেতর তিনি কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। পাকিস্তানের মতো দেশে এসব অকল্পনীয়। এ আলোচনা পরে। সবচেয়ে নজরকাড়া পদক্ষেপ মনে হচ্ছে চীনের ক্ষেত্রে। কয়েকদিন আগে পাকিস্তানের বাণিজ্য, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়কমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক দাউদ বলেছেন, চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপেক) কর্মসূচি স্থগিত করা দরকার। এ সিপেক-এ ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োজিত হওয়ার কথা। তিনি বলছেন, এক বছর সিপেক-এর কাজ স্থগিত থাকা দরকার। এর অধীন প্রকল্পগুলোর প্রতিটির পর্যালোচনা (রিভিউ) দরকার। তার মতে, এসব প্রকল্পে চীনকে অনেক বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের তির নওয়াজ পরিবারের দিকে। দেখা যাচ্ছে, চীনা কোম্পানিগুলোকে যেসব কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা পাকিস্তানি কোনো কোম্পানিই পায়নি। বলা বাহুল্য, ইমরান খান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের পর পাকিস্তানের বাজার থমকে দাঁড়ায়। বিনিয়োগকারীরা থমকে দাঁড়ায়। শেয়ারবাজার থমকে দাঁড়ায়। এ কী বলছে ইমরান সরকার! এত সাহস? চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হয়, এমন মন্তব্য করবে পাকিস্তানি কোনো সরকার; তা অনেকেরই চিন্তার বাইরে। অথচ ইমরান খান সরকার তা-ই করল, যে সরকার কিনা আবার সেনাবাহিনী সমর্থিত বলে বাজারে কানাঘুষা আছে।
প্রাক্তন এক পাকিস্তানি মন্ত্রী বলেছেন, বাণিজ্য, শিল্প ও বিনিয়োগ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক দাউদ এমন সময় সিপেক প্রকল্প সম্পর্কে বললেন, যখন দু-একদিন আগেই চীনের শীর্ষস্থানীয় একটি সরকারি প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করে দেশে ফিরে গেছে। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? পাকিস্তান কি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের পথ ধরল? ড. মাহাথির কিছুদিন আগে পুনরায় ক্ষমতায় এসেই যে কাজটি করলেন, তা অভাবনীয়। তিনি চীনা অর্থায়িত খুবই বড় দুটো প্রকল্প বাতিল করে দিলেন। একটি প্রকল্পে দশ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। কোটি কোটি টাকা দাম। সমুদ্রে কৃত্রিমভাবে দ্বীপ তৈরি করে ওইসব ফ্ল্যাট নির্মাণ হচ্ছে। ড. মাহাথিরের প্রশ্ন, এসব ফ্ল্যাটে কারা থাকবে? চীনা ধনী, না মালয়েশিয়ানরা? মালয়েশিয়ানদের অত অর্থ নেই। এগুলো উন্নয়নের কোনো নমুনা নয়। দ্বিতীয় প্রকল্পটি একটি রেল প্রকল্প। মালয়েশিয়ার পূর্বপ্রান্ত থেকে একদম সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। একই প্রশ্ন মাহাথিরের। তিনি বলছেন, চীনা ঋণে মালয়েশিয়া ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। এ ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা মালয়েশিয়ার নেই। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার মতো করে জমি লিখে দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চীনা এসব উদ্যোগকে ‘নয়া উপনিবেশবাদী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন মাহাথির। এবং তা কিছুদিন আগে তিনি চীন বেড়াতে গিয়ে বলে এসেছেন। তিনি বলেছেন ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ ভালো, তবে দেশের পর দেশকে ঋণী করে বিশ্বকে এক করলে চলবে না।
মাহাথিরের উপলব্ধি যা, ছক্কামারা ক্রিকেটার পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানেরও কি তা? দৃশ্যত তা-ই মনে হচ্ছে। তা না হলে ৬০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলারের ‘পাকিস্তানি প্রেস্টিজ প্রজেক্ট’ কী করে স্থগিতের কথা ভাবা হচ্ছে? শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে, তা আগামী দিনই বলবে। প্রকল্পটি শুরু হয়েছে কাশ্মীরের মাথায় গিলগিট নামীয় স্থানে, যেখানে চীন-পাকিস্তান-কাশ্মীর সীমান্ত একাকার হয়ে যায়। যে কাশ্মীরি অঞ্চলে এর শুরু, তা বিতর্কিত। তাই ভারত এ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে শুরু থেকে। ভারত অবশ্য শুধু সিপেক-এর বিরোধিতা করছে না; বিরোধিতা করছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ-এরই। তাদের কথা, বাণিজ্যের জন্য বিশ্বের রাস্তাঘাট, সমুদ্রপথ একমুখী করতে হলে তা হওয়া উচিত যৌথ উদ্যোগে। একদেশীয় উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কাশ্মীর উপত্যকা থেকে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে নামতে নামতে সিপেক শেষ হবে বেলুচিস্তানের সাদারে। এখানে হচ্ছে ‘সমুদ্রবন্দর’। নামে সমুদ্রবন্দর; কার্যত তা হবে সামরিক ব্যবহারের জন্য। ভারত এর প্রতিবন্ধক হিসেবে গড়ে তুলেছে ইরানে একটি বন্দর। নাম ‘ছাবাহার’। এদিকে সিপেক প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানে বিতর্কিত। এটা মূলত ঋণনির্ভর। সুদের হার উচ্চ। শর্ত কঠিন। সব চীনা পণ্য, শ্রমিক-কর্মচারী ও টেকনিক্যাল লোকÑসব চীনা। অভিযোগ, ৮০ টাকার পণ্য চীন থেকে পাকিস্তানে ঢুকে; অথচ বিল হচ্ছে ১০০ টাকার। পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের এতে অংশগ্রহণ নেই। অথচ বলা হচ্ছে, সিপেক হলে পাকিস্তানেরই লাভ। অবকাঠামো গড়ে উঠবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, ততই দেখা যাচ্ছে চীনা ঋণের অর্থ পরিশোধের সময় হয়ে আসছে। অথচ পাকিস্তানের ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নেই। অর্থনীতি স্থবির, যদিও ইদানীংকালে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা গতি এসেছে। আমদানি দিনদিন বাড়ছে। অথচ রফতানি বৃদ্ধি নেই। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি। রিজার্ভের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে, যা মাত্র দুই মাসের আমদানি চাহিদা মেটাতে পারে। অথচ আজকাল ৯ মাসের আমদানির সমান বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকতে হয়। দেখা যাচ্ছে, বছরখানেক আগেও পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার। সিপেক প্রজেক্টের কারণে আমদানি বেড়ে গেছে। অথচ রফতানি বাড়েনি, রেমিট্যান্স বাড়েনি। ট্রেড ডেফিসিট দাঁড়িয়েছে ৩৬-৩৭ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট দিনদিন বাড়ছে। এদিকে এর প্রভাব পড়েছে রুপির দামে। ১২০-১৩০ রুপিতে কিনতে হচ্ছে এক ডলার। এমার্জিং মার্কেটের অন্যান্য মুদ্রার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে পাকিস্তানি মুদ্রার দরপতন ঘটছে। দেশটিতে শিক্ষিতের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে লোক ৩০ শতাংশ। দেশে বিদ্যুতের দারুণ অভাব। আফগানিস্তানের সঙ্গে খারাপ সম্পর্কের ফলে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার পাকিস্তানি প্রাণ হারিয়েছে। এহেন পাকিস্তান এখন আতঙ্কে রয়েছে। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি ‘বেইল আউট’ করেছে। সামনে পাকিস্তানের দরকার আরেকটি বেইল আউট। চীন একবার সাহায্য করেছে। এখন পাকিস্তান চাপে আছে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে। দেশটি নানা ধরনের সাহায্য দেওয়া ধীরে ধীরে বন্ধ করছে। সন্ত্রাসীদের মদদ দিলে দেশটি পাকিস্তানের ওপর আরও কঠোর হবে, প্রতিদিন জানাচ্ছে। এখন যে চাপে আছে পাকিস্তান, তা থেকে বাঁচাতে পারে হয় আইএমএফ; নয়তো সৌদি আরব, নয়তো ইসলামি ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি)। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা। পাকিস্তানের দরকার সেচের জল, খাবারের জল। দরকার বিদ্যুৎ। কোটি কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে। শিক্ষিতের হার নি¤œ। এসব সমস্যার সমাধান দরকার। বৈষম্য দূর করা চাই। অপচয় দূর করা দরকার। এর সর্বশেষটি দূর করতে ইমরান খান কিছু জনপ্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িঘোড়ার খরচ কমাচ্ছেন। অপ্রয়োজনীয় গাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। চাকর-বাকরের সংখ্যা কমাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এসবে তো আর দেউলিয়াত্বের সমাধান হবে না। ইমরান খান দেশবাসীর কাছ থেকে তিন মাস সময় নিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি পাকিস্তানের প্রশাসনে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এরই মধ্যে এলো সিপেক-এর এই ঘোষণা। দেখা যাক, সিপেক ও চীনের সম্পর্ক তিনি কীভাবে মোকাবিলা করেন।
চীন যে কাজে-অকাজে ঋণ দিয়ে সারা বিশ্বে একটা ঋণ বিশৃঙ্খলার জš§ দিচ্ছে, তার আরেকটি উদাহরণ প্রশান্ত মহাসগরীয় অঞ্চলের ছোট দ্বীপগুলো। এ অঞ্চলের ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর অধীনে চীন থেকে ঋণ নিয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বরের একটি রিপোর্টে দেখলাম, এখন সেসব ঋণ পরিশোধের সময় হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশ তা পরিশোধ করতে পারছে না। এ নিয়ে উত্তপ্ত পরিবেশের জš§ হচ্ছে। চীনারা এসব দেশকে তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদের জন্য চাপ দিচ্ছে। তারা আচার-ব্যবহার খারাপ করছে। এদিকে মিয়ানমারও একটি বড় চীনা প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোরও একই অবস্থা। পাকিস্তানের মতো সর্বত্রই আজ চীনা ঋণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এদিকে চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতো নেই। ট্রাম্পের ‘ট্রেড ওয়ার’ চীনকে বাস্তববাদী হতে বাধ্য করছে বলেই মনে হয়। ভবিষ্যতে দেখার বিষয়, চীনা ঋণের গতিপ্রকৃতি কী হয়।

অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক