চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা বেড়ে গেছে : রেজাউল করিম খোকন

সদ্য সমাপ্ত বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। আরও বিনিয়োগ প্রস্তাব পাইপলাইনে রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা, জুলাই বিপ্লবের পর সংঘটিত অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিনিয়োগকারী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকেরা অংশ নেন। সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এদিন সম্মেলনস্থলে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা পরীক্ষামূলকভাবে সবার জন্য উš§ুক্ত করা হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ৭ এপ্রিল থেকে চার দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। তবে সম্মেলনে যারা অংশীদার হিসেবে ছিলেন, তারা ব্যয় করেছেন প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চার দিনের সম্মেলনে খরচ হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলনে প্রায় ৪৫০ বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ নেন। তারা দেশের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘুরে দেখেন। বিনিয়োগ পরিবেশেরও খোঁজ নেন। সম্মেলনে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগে সমঝোতা চুক্তি করেছে চীনা একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই সম্মেলনেই স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা জানানো হয়। এ ছাড়া একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সম্মেলনের আয়োজক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, এখন তারা এসব বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি নিয়মিতভাবে ‘ট্র্যাকিং’ করবে। এজন্য বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে সংস্থাটি, যাতে প্রতিশ্রুতিগুলো প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ নেয়। সম্মেলনে আগত বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ প্রশ্নই ছিল ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে। বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, এ দেশে বিনিয়োগের বড় বাধা নীতি ধারাবাহিকতার অভাব। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, শুল্ককর, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যাও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা সরকারের অবস্থান জানতে চান। বিনিয়োগের বিদ্যমান বাধাগুলো চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশ কোন ধরনের বিনিয়োগ প্রত্যাশা করছে এবং সেজন্য কী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেগুলো বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। সম্মেলনে কত বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে, সেটি মুখ্য নয়। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের একটি পাইপলাইন তৈরি করা, যাতে তাদের ট্র্যাক করে পরবর্তী সময়ে বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যায়। আগের বিনিয়োগ সম্মেলনেও অনেক প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতি ট্র্যাক না করায় সেগুলো প্রতিশ্রুতিই থেকে গেছে। সাধারণত একটি বিনিয়োগ আলোর মুখ দেখতে ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় লাগে। এই সময়ের আলোকে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি সুস্পষ্ট পথনকশা তৈরি করতে হবে। যেসব বিদেশির কাছ থেকে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতিগুলোকে প্রকৃত বিনিয়োগে রূপ দিতে হবে।

চার দিনের সম্মেলনে তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে তারা কী পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে, সে রকম কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে এ দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্পেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম ও চীনের তৈরি পোশাক কোম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ। এর মধ্যে হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে বলে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এর বাইরে স্টার্টআপ কোম্পানি শপআপের ১১ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার কথা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে আগামী মাসে ২০০ বিনিয়োগকারীসহ চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে গেছে। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর বাংলাদেশ সফরকালে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে প্রথমবারের মতো একটি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। নাসার আর্টেমিস কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত এই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৫২টি দেশের সঙ্গে মিলে মহাকাশ অনুসন্ধানে অংশ নিতে পারবেন বাংলাদেশি তরুণেরা। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে বিডা। তৈরি পোশাক, ডিজিটাল অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, সেমিকন্ডাক্টর এবং কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে এসব অধিবেশনে আলোচনা হয়। সম্মেলনে দেশীয় উদ্যোক্তারা অংশ নেন। তার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বেজা ও বিডার গভর্নিং বোর্ডের বৈঠকে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ বাতিল করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অনুমোদন পাওয়া ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম বাতিল করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। বাতিল হওয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে পাঁচটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বেজার গভর্নিং বোর্ডের সভায় ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে ১০টিকে চূড়ান্তভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দেশে বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করা সংস্থা মোট আটটি। এসব সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং নেপালের জন্য একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যদি কেউ বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসেন (বাংলাদেশি কেউ) তাকে কোনোভাবে প্রণোদনা দেয়া যায় কি না, বৈঠকে সেই আলোচনা হয়েছে। বেজা, বিডাসহ অনেক সংস্থার এক দরজায় সেবা (ওএসএস) রয়েছে। তবে অনেক সংস্থার ওএসএসের অনলাইন আবেদনের পাশাপাশি অফলাইনে আবেদনের সুযোগও থাকে। প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন, যেসব সংস্থার অনলাইন সেবার সুযোগ রয়েছে, তাদের ম্যানুয়াল সেবাপদ্ধতি এক মাসের মধ্যে বন্ধ করে দিতে হবে। এ ছাড়া ওএসএস মিলিয়ে একটি একক (সিঙ্গেল) পোর্টাল করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোরিয়ান ইপিজেডকে বেজার অধীনে আনার একটি প্রস্তাব উঠেছিল। বেজার গভর্নিং বোর্ডের বৈঠকে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ফলে এখন থেকে কোরিয়ান ইপিজেড বেজার অধীনে পরিচালিত হবে। বাতিল হওয়া সরকারি পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হলো কক্সবাজারের সোনাদিয়া ইকোট্যুরিজম পার্ক, বাগেরহাটের সুন্দরবন ট্যুরিজম পার্ক, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, গাজীপুরের শ্রীপুর অর্থনৈতিক অঞ্চল ও ময়মনসিংহ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত বিজিএমইএ পোশাকশিল্প পার্ক, সুনামগঞ্জের ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চল, বাগেরহাটের ফমকম অর্থনৈতিক অঞ্চল, ঢাকা জেলার সিটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। তবে এক দশকের বেশি সময়ে কয়েকটি বেসরকারি অঞ্চল ছাড়া সফল কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এমন বাস্তবতায় অন্তর্র্বর্তী সরকার এসে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন করতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় গত জানুয়ারি মাসে বেজার পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের বদলে আপাতত পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার স্বল্পমেয়াদি ও সময়-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এই পাঁচ অর্থনৈতিক অঞ্চল সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সবার মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। তাতে দুই বছরের মধ্যে পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৩৩টি শিল্পকারখানা নির্মাণ, ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এবং প্রায় ২ লাখ ৩৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি একেবারে বাদ দেয়া হচ্ছে না, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে তা থাকবে। কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন বাতিলও হতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ বেজার গভর্নিং বোর্ডের সভায় ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাতিলের ঘোষণা এলো।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে চলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনও ১২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশসহ প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য সামনে নতুন সুযোগ নিয়ে আসতে পারে। উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অধিকাংশ পণ্যে চীনের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকবে না। ফলে চীন থেকে মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ সরাবে। সঙ্গে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও স্থানান্তরিত হবে। চীনের ব্যবসা নিতে হলে বাংলাদেশের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। ব্যবসা সহজীকরণেও সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ) আরোপ করেন। এ ছাড়া ৫৭ দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়, যদিও পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের স্থগিত করেছেন ট্রাম্প। তবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক সব দেশের পণ্যের ওপর বহাল রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রা বেড়ে চলেছে। শুরুতে ২ এপ্রিল চীনের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরে তা বেড়ে হয়েছে ১৪৫ শতাংশ। বিপরীতে চীনে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্ক বেড়ে হয়েছে ১২৫ শতাংশ। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পণ্যবাণিজ্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এটি মোট বৈশ্বিক বাণিজ্যের তিন শতাংশ। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতির বড় ক্ষতি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৫৮২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। তার মধ্যে চীন থেকে দেশটিতে ৪৩৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে চীন। চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য খুবই নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের সেনসাস ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত বছর উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। দেশটি থেকে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। পাল্টা শুল্ক আরোপের কারণে তৈরি পোশাক, চামড়া পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিকারকেরা মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ স্থগিতাদেশ পেতে শুরু করেছিলেন। এখন সেগুলো আবার ফিরছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। আমাদের রপ্তানিকারকেরা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে বেশ কিছু ই-মেইল পেয়েছেন। তারা চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরাতে চায়। কারণ দেশটির ওপর যে হারে শুল্ক বসেছে, তাতে মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো চীন থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে ব্যবসা করতে পারবে না। উচ্চ শুল্ক আরোপের পর চীনের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত করতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। চীন থেকে বর্তমানে জাহাজে করে যেসব পণ্য যাচ্ছে, সেগুলোও বাতিল করে দিচ্ছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপকে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ মনে করা যেতে পারে। চীনের ব্যবসা নিতে আমাদের প্রতিযোগী দেশও চেষ্টা করবে। তবে আমাদের অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে, যা অনেকের নেই। ঠিকমতো কাজ করতে পারলে আগামী ১০ বছরের জন্য সম্ভাবনা খুলে যাবে আমাদের। চীনের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকেরা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে নজর দিচ্ছে। তারা অনেক কম দাম প্রস্তাব করছে, কারণ দেশটির সরকার প্রচুর ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে আমাদের যেসব প্রতিষ্ঠান শুধু ইইউ বাজারে পণ্য রপ্তানি করে, তাদের প্রতিযোগিতা বেড়ে যেতে পারে। ইউএন কমট্রেড, চীনের কাস্টমস ও ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় ইলেকট্রনিকস পণ্য। তারপর রয়েছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স, তৈরি পোশাক, চিকিৎসা পণ্য, কাঠের পণ্য, নির্মাণযন্ত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি, রাসায়নিক দ্রব্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, যাতায়াতের সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ও চামড়ার পণ্য।

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা থাকবে। তাতে স্বল্প মেয়াদে পণ্যের চাহিদা কমে যেতে পারে। তবে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের জন্য সোনালি সময় আসবে। কারণ চীন থেকে ব্যবসা ও বিনিয়োগ দুটোই সরবে। চীন আগামী দিনে যতই দর-কষাকষি করুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অতিরিক্ত শুল্ক শূন্য হবে না। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। তারপর রয়েছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে রপ্তানি হওয়া পণ্যের মধ্যে ৮৭ শতাংশ তৈরি পোশাক। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে দাঁড়াত ৫২ শতাংশ। পাল্টা শুল্ক স্থগিত হওয়ায় আগামী তিন মাস ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক থাকছে। তাতে গড় মোট শুল্ক হবে ২৫ শতাংশ। তার বিপরীতে চীনের পণ্যে নতুন শুল্ক বসেছে ১৪৫ শতাংশ। চীন থেকে রপ্তানি হওয়া উচ্চমূল্যের পোশাকের ক্রয়াদেশ সরবে। আমাদের সেসব পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। চীন থেকে বিনিয়োগ সরবে। তার একটি অংশের গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। তবে বিনিয়োগ নেয়ার ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পোশাক, কৃত্রিম তন্তু, ইলেকট্রনিকস, জুতা ও খেলনা উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। তবে তার আগে পাল্টা শুল্ক থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক