মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: বোরো ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ক্ষতি পোষাতে ভুট্টা চাষে ঝুঁকে পড়েছে চুয়াডাঙ্গার কৃষক। কিন্তু ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির বাহারি মোড়কে হাইব্রিড ভুট্টা বীজে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। সেসব বীজে পোকা ধরায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষি।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় ১৪ হাজার ৯০০, আলমডাঙ্গা উপজেলায় ১২ হাজার, দামুড়হুদা উপজেলায় ১৫ হাজার ও জীবননগর উপজেলায় চার হাজার ২২১ হেক্টরসহ জেলায় মোট ৪৬ হাজার ১২১ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টার আবাদ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা, ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় তারা ব্যাপক হারে ভুট্টা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, ভুট্টার বীজ সংরক্ষণ বা উৎপাদন করার মতো প্রযুক্তি কৃষকের নেই। তাই বাধ্য হয়ে বিভিন্ন কোম্পানির আমদানি করা বা উৎপাদিত ভুট্টা বীজ কিনতে হয় তাদের। সে সুযোগে কোম্পানির প্রতিনিধিরা মেয়াদোত্তীর্ণ ও পোকাধরা বীজ গ্রামাঞ্চলের কৃষকের কাছে বিক্রি করে। এতে প্রতারিত হচ্ছে কৃষক।
সদর উপজেলার বেগমপুর গ্রামের কৃষক অনিল কুমার, বরকত, আত্তাব, আবদুল, বিপুলসহ অনেকেই জানান, এক বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদের জন্য বীজ লাগে তিন কেজি। এ বছর তারা পাইওনিয়ার কোম্পানির পি-৩৩৫৫ জাতের ভুট্টা বীজ কিনেছেন। প্যাকেট খুলে দেখা গেছে, বীজে পোকা ধরেছে। বীজের মাথা পোকায় খেয়ে ছিদ্র করে ফেলেছে।
সদর উপজেলার ডিলার উজ্জ্বল হোসেন, সরোজগঞ্জ বাজারের ডিলার কামাল হোসেন জানান, পাইওনিয়ার কোম্পানির এক কেজি বীজ ৬৩০ থেকে সাড়ে ৬০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ওই বীজে প্যাকেটপ্রতি ১০০ থেকে ৫০ গ্রামে পোকা থাকতে পারে।
বীজ ডিলার কামাল উদ্দিন সান্টু জানান, তিনি দামুড়হুদা উপজেলার ডিলার। বীজে পোকা দেখা গেছে, দোকানি ও কৃষক তাকে জানিয়েছেন। পোকা থাকা বীজ কৃষকরা ফেরত দিলে তা নেওয়া হবে।
এক বীজ বিক্রেতা জানান, প্রতি বছর বিভিন্ন কোম্পানি ২৫ কেজি ওজনের বীজের বস্তা আমদানি করে। পরে সে বস্তা খুলে এক কেজি ও দুই কেজির প্যাকেটে ভরে বাজারে ছাড়ে। মৌসুমের শেষে যেসব বীজ অবিক্রীত থাকে, সেগুলো পরের বছর আবার নতুন প্যাকেটে ভরে বাজারে বিক্রি করা হয়। পাইওনিয়ার পি-৩৩৫৫ জাতের বীজের ক্ষেত্রে তেমনটিই ঘটেছে। তিনি অন্য জেলা থেকে এ বীজ এনে বিক্রি করছেন, কোনো অভিযোগ আসেনি।
চুয়াডাঙ্গার দোস্ত ও বেগমপুর ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পোকাধরা বীজের নমুনা সংগ্রহ করে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, পোকাধরা বীজ বাজারজাত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি তাদের কানে এসেছে। ডিলারদের বাজার থেকে বীজ তুলে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তারপরও যদি কেউ ওই বীজ বিক্রি করেন, তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চুয়াডাঙ্গা বীজ বিপণনের উপপরিচালক একেএম কামরুজ্জামান জানান, চাহিদা মোতাবেক দেশে ভুট্টাবীজ উৎপাদন হয় না। তাই বিভিন্ন কোম্পানি দেশের বাইরে থেকে বীজ আমদানি করে থাকে। তারা কি ধরনের বীজ কৃষকের কাছে বিক্রি করে, তা দেখার জন্য লোকবল প্রয়োজন। লোকবল সংকটের কারণে সবকিছু দেখা সম্ভব হচ্ছে না। চুয়াডাঙ্গায় লোকবল থাকার কথা ৪১ জন কিন্তু আছেন ১৩ জন। তারপরও সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে। জেলায় বিএডিসির অনুমোদিত বীজ ডিলার ৯২ জন। এ বছর এখনও বিএডিসির ভুট্টাবীজ বাজারজাত শুরু হয়নি। পোকা-আক্রান্ত বীজ কোনোভাবেই বাজারজাত করা যাবে না। এটা আইনসিদ্ধ নয়। যদি কেউ করে থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও এটা দেখার কথা জেলা বীজ প্রত্যয়ন বিভাগের।
জেলা বীজ প্রত্যয়ন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, সব ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়া হয় জেলা থেকে; অথচ বীজ বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ের বীজ অনুবিভাগ থেকে। যার ফলে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য তাদের কাছে দেওয়া হয় না। তবুও বীজসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে খতিয়ে দেখা হবে। তবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব কৃষি বিভাগের। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আলী হাসান জানান, বীজ কিনে কেউ যদি প্রতারিত হন এবং কোনো কৃষক যদি অভিযোগ করেন, তাহলে ওই অভিযুক্ত বীজ কোম্পানির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। গত ২৩ অক্টোবর জেলায় পেট্রোকম ভুট্টা বীজ কোম্পানির প্রতিনিধিদের ডেকে এনে পাওনিয়ার পি-৩৩৫৫ জাতের পোকাধরা ভুট্টাবীজ বাজার থেকে উঠিয়ে নিতে বলা হয়েছে। তারপরও যদি ওই কোম্পানি ওই পোকাধরা বীজ বাজারজাতের চেষ্টা চালায়, তাহলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।