অর্থপাচারে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ

চুরির আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে: গভর্নর

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: অর্থপাচারে বাংলাদেশ একটা বড় ভিকটিম দেশ। আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী মানি লন্ডারিং করে সম্পদ চুরি করে বাইরে নিয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর, রোগের উৎপত্তি রোধ করা প্রধান দায়িত্ব। রোগ সারানো হচ্ছে পরে। চুরি হওয়ার পরে বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই। চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হয়ে গেছে যা, তা হয়ে গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কোনো কিছু যেন না হয়, তা আমরা ঠিক করতে আসছি। এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় রেগুলেটরি সংশোধন করতে চাই।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং সমসাময়িক ব্যংকিং বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে গতকাল বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এসব কথা বলেন। দেশের সব ব্যাংকের অর্থপাচার রোধে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভায় অংশ নিতে আসেন গভর্নর। 

তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট বলে একটা কথা আছে। সব জিনিসে সবসময় মামলায় দীর্ঘসূত্রতায় যাওয়ার মানে হয় না। কতটা শক্তভাবে তাদের ধরতে পারি। ভালোভাবে ধরতে পারলে আপসটাও ভালোভাবে হয়। তাদের সম্পদ শনাক্ত না করলে আমরা ঠকে যাবে। আপসে যেতে হলে সঠিক তথ্য বের করতে হবে। তথ্যে গরমিল হওয়া যাবে না। যত ভালো তথ্য পাব তত ভালোভাবে ধরা যাবে। আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথা বলছি, চিঠি দিচ্ছি। ল ফার্মগুলোর সঙ্গে কথা বলছি।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ এটা একেবারেই বাংলাদেশের জন্য নতুন। সিস্টেমেটিক্যালি এ ধরনের প্রবলেম আগে ফেস করিনি। ফেস করে থাকলেও এ ধরনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি। এই প্রথম আমরা এটা করছি। সেজন্য আমাদের অনেক শিখতে হচ্ছে। এটা তো দেশের আইনে হবে না। বিদেশিদের সঙ্গে আমাকে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের আইনের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হবে। প্রথম ধাপে চেষ্টা করতে হবে সম্পদগুলো চিহ্নিত করা। সেই ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করছি। আইনি সহায়তার জন্য আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি। বিভিন্ন ল ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি, তাদের হয়তো খুব শিগগির হায়ার করব। আমরা কিছু ফার্মের সঙ্গে কথা বলছি যারা কার সম্পদ কোথায় আছে তা বের করবে। আমরা ভাসা-ভাসাভাবে জানি সিঙ্গাপুরে আছে, অমুক দেশে আছে। সঠিক তথ্য না পেলে আদালতে টিকবে না। কাজেই আমাকে সেভাবে তথ্য নিয়ে আসতে হবে। সেই জন্য বিদেশি অ্যাসেট ট্রেসিং ফার্মের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাব, কোম্পানি ও সম্পদ শনাক্ত করতে হবে। আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি বিদেশিদের কাছ থেকে। তারপরেও জিনিসটা এত সহজ নয়, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে সম্পদ শনাক্ত করা। এরপর আদালতে যেতে হয়। কয়েক বছর লেগে যায়। 

চট্টগ্রামেরই বড় গ্রুপের অন্ততপক্ষে সোয়া লাখ কোটি টাকা থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংক খাত থেকে। আরও কিছু গ্রুপ আছে। ২০, ৪০, ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। আমার ধারণা বড় গ্রুপগুলোর আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। ছোটগুলো বাদে। সেগুলোও আদায় করতে হবে অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ায়। 

গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। আমরা মনে করি, আমরা সেখানে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি। আরও হবে আশা করি। আমরা সঠিক পথে আছি। আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের গোলযোগ আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েনি, বাড়ছে। ডাবল ডিজিট গ্রোথ দেখতে পাচ্ছি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ উৎসাহব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমিক এক্সটারনাল সেক্টরে একটা স্বস্তির জায়গায় আমরা চলে এসেছি। কোনো ধরনের কোনো রকমের ক্রাইসিস আছে বলে আমি মনে করি না এবং হবে বলে আমি মনে করি না। আমরা একটা সুদৃঢ় অবস্থানে এসেছি। 

মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা চলমান। আমাদের প্রচেষ্টা আংশিকভাবে সফল হয়েছে। আপনারা জানেন, আগস্ট মাসে যখন প্রথম নতুন তথ্য এলো, আগে তথ্য নাকি কমই দেখানো হতো। প্রথম ছেড়ে দেয়া হলো। খাদ্যে সেপ্টেম্বরে সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত মাসে আট শতাংশের একটু বেশি আছে। মোটামুটি সন্তোষজনক। নন-ফুড সাড়ে ১২ থেকে কমে এখন সাড়ে ৯ শতাংশে নেমেছে। আমি আশাবাদী, এটা আরও কমবে সামনে। সাধারণত খাদ্যমূল্য বাড়লেই নন-ফুড মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। খাদ্যমূল্য বাড়লে রিকশাভাড়া, বাড়িভাড়া ও চুল কাটার খরচ ক্রমে বাড়ে। খাদ্যমূল্য কমলে তখন আবার নন-ফুড আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা স্বস্তির জায়গার দিকে যাচ্ছি। জুনের শেষে, জুলাই মাসে রেজাল্ট পাব মূল্যস্ফীতি হয়তো সাত-আটের মধ্যে পাব। ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এটাকে পাঁচ বা তার নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। 

পলিসি রেসপন্সে সময় লাগে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওষুধ দিলেই সব রোগী ভালো হয়ে যায় না, সময় লাগে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, সব সার যেন সময়মতো আসে। বোরো ধার বুনতে যেন কোনো অসুবিধা না হয় কৃষকের। বিদ্যুতের সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করতে পেরেছি। আমাদের নিজের টাকায়ই করেছি।