ছিনতাইয়ের কাজে মাদকের ব্যবহার

ইমদাদ ইসলাম: সম্প্রতি ঢাকার জনৈক ব্যবসায়ী নগদ টাকার প্রয়োজনে তার আইফোনটি বিক্রি করার জন্য বিক্রয় ডটকমে একটি বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপন দেয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই জনৈক ব্যক্তি ফোন করে মোবাইলটি কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নির্ধারিত সময়ে মোবাইলের মালিকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে মোবাইলটি দেখে পছন্দ করেন। ক্রেতা ব্যবসায়ীর অফিসে একটা স্কচ টেপ প্যাকেট রেখে টাকা আনার জন্য বেরিয়ে যান এবং এক ঘণ্টার মধ্যে টাকা পরিশোধ করে মোবাইলটা নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে লোকটি ফিরে এসে তার ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে ব্যবসায়ীর হাতে দেন এবং তাকে টাকা বুঝে পেয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন। ব্যবসায়ী কাগজে স্বাক্ষর করার পর কাগজটি তার কাছে রাখেন এবং টাকা দিতে বলেন। ক্রেতা তার ব্যাগ থেকে একটি প্যাকেট বের করে ব্যবসায়ীকে দিয়ে সেটা এর আগে রেখে যাওয়া স্কচ টেপ দিয়ে প্যাঁচাতে বলেন এবং ব্যবসায়ীর হাত থেকে আইফোনটি নিয়ে দ্রুত চলে যান। ব্যবসায়ী ২০-২৫ মিনিট ধরে স্কচ টেপ দিয়ে প্যাকেটটি প্যাঁচাতে থাকেন। এরপর যখন তিনি স্বাভাবিক হন তখন দেখেন তার আইফোন নেই, তিনি শারীরিকভাবে খুব দুর্বল অনুভব করেন। অনেক কিছুই মনে করতে পারেন না। অতঃপর পরিবারের সদস্যরা তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করেন। দুই দিন চিকিৎসা নিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফেরেন।

একটু সুস্থ হওয়ার পর ধীরে ধীরে তার সবকিছু মনে পড়তে থাকে। অফিসের সিসি ক্যামেরার রেকর্ড করা ফুটেজ দেখে  বুঝতে পারেন, কীভাবে তার আইফোনটি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি কালবিলম্ব না করে সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা সিসি ক্যামেরায় রেকর্ডকৃত ফুটেজ দেখে অবাক হয়ে যান। কীভাবে সম্ভব, ক্রেতা সেজে কোনোরকম বাধা ছাড়াই আইফোনটি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে দুষ্কৃতকারী আর আইফোনের মালিক স্কচ টেপ প্যাঁচাচ্ছে একটি প্যাকেটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে।

বর্তমান বিশ্বে কম-বেশি এক লাখ ২০ হাজার ধরনের মাদক রয়েছে। এ পর্যন্ত কম-বেশি চার হাজার উদ্ভিদের বিষয় বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, যেগুলো সরাসরি মাদক কিংবা মাদকের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশেও নানারকম মাদকের ব্যবহার দেখা যায়। এরকমই একটি মাদক হলো এলএসডি। খঝউ হলো ঊৎমড়ষরহ ধহফ অষশধষড়রফ-এর জাতক। এটি স্বচ্ছ ও গন্ধহীন একটি পদার্থ। এটি খুব সহজেই পানিতে মিশে যায়। এই মাদকের প্রভাবে মানুষের মতিভ্রম ঘটে। মাদক ব্যবহারকারী বা যে কেউ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক এলএসডি মাদকের সংস্পর্শে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে এর প্রভাব শুরু হয়। এলএসডি মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে কাল্পনিক দৃশ্য তৈরি করে কাল্পনিক ইন্দ্রিয় অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি, এমনকি কাল্পনিক সময়, অনুভূতি ও সজাগ ভাব নিয়ে হ্যালুসিনেশন  করে। অর্থাৎ মানুষ ওই সময় যা কিছু অনুভব করে, তার সত্যিকার অর্থে কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এলএসডির প্রভাব স্থায়ী হয় এর ডোজ অনুসারে। কখনও কখনও এর ডোজের প্রভাব ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত দেখা যায়।

এলএসডি আসক্তদের ক্ষেত্রে নানারকম উপসর্গ দেখা যায়, যেমন অন্যসব মাদকাসক্তদের মতো অস্বাভাবিক আচরণ, ক্ষুধামান্দ্য, ঘুমের সমস্যা, শারীরিক পরিবর্তন, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, এলোমেলো জীবনযাপন, নৈতিকতা লোপ পাওয়া প্রভৃতি। এলএসডি অন্যান্য মাদকের চেয়ে অনেক কস্টলি ও দুষ্প্রাপ্য। আমাদের দেশে এর বিস্তার কিছুটা কম। কিন্তু সম্প্রতি বেশকিছু জায়গায় দুষ্কৃতকারীরা এ ধরনের মাদকের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে বিপদে ফেলে তাদের মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে নিচ্ছে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যদিও তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয় এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদক এসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভিকটিমের দৃষ্টিভ্রম ও হ্যালুসিনেশনের প্রভাব দেখা গেছে। এলএসডি ব্যবহারে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও ইন্দ্রিয়গত ক্ষতি হয়ে থাকে। এ ধরনের মাদক ব্যবহারে চোখের পিউপিলের প্রসারণ, ক্ষুধামান্দ্যভাব, অনিদ্রা, শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি, হার্টবিট বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি নানারকম সমস্যা দেখা দেয়। মানসিক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় লক্ষণগুলো হলো খারাপ আবেগে উজ্জীবিত হওয়া, কোনো কারণ ছাড়া ভয়, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, অবিশ্বাস, আশাহত, এমনকি এর প্রভাবে আত্মহত্যা পর্যন্ত সংঘটিত হতে পারে। আর ইন্দ্রিয়গত সমস্যার মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিভ্রম ও হ্যালুসিনেশন। এলএসডির মাত্রা যত বেশি হবে, হ্যালুসিনেশনের মাত্রাও তত বাড়বে। এলএসডি গ্রহণকারী মনে করেন তিনি আকাশে উঠছেন, বিভিন্ন রকম ফুলের বাগানে ভেসে বেড়াচ্ছেন, আশেপাশের পরিবেশ সবকিছু পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, কিংবা তিনি অতীতে ফিরে যাচ্ছেন। এমন সব অবাস্তব কল্পনা আসক্ত ব্যক্তির ওপর ভর করে। আর একটি বড় সমস্যা হলো এলএসডি গ্রহণের ফলে শরীরের মধ্যে উড়ঢ়ধসরহব তৈরি হয় এবং প্রাকৃতিকভাবে উড়ঢ়ধসরহব তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে আসক্ত ব্যক্তির এলএসডির ওপর নির্ভরশীলতার সৃষ্টি হয়। আসক্ত ব্যক্তি মনে করে তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। আসলে এসব কিছুই তার কল্পনা। তিনি মনে করেন তার পক্ষে আকাশে উড়ে বেড়ানো, এমনকি এক ঘুষিতে একটি বিল্ডিং ভেঙে ফেলাও সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজেকে সুপারম্যান ভাবেন, যা শুধুই কল্পনা, সত্য নয়।

১৯৩৮ সালে সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের ওষুধ হিসেবে এলএসডি আবিষ্কার করেন। এলএসডি আবিষ্কারের পাঁচ বছর পর ১৯৪৩ সালে হফম্যান নিজের অজান্তে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম সেবন করেন। এর ফলে তার মাথাব্যথাসহ কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। হফম্যান এলএসডি গ্রহণের অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রথম মতামত দেন। এরপর হফম্যানের সহকর্মীরা সবাই স্বাদ, বর্ণ ও রংহীন সেই সাইকেডেলিক ড্রাগ একে একে টেস্ট করলেন। সবাই এটি ব্যবহারের পরপরই নতুন এক স্বপ্নিল জগতের দেখা পেলেন, যা চিন্তাচেতনাকে মুহূর্তে প্রভাবিত করতে পারে। ১৯৪৭ সালে এলএসডি’কে ওষুধ হিসেবে প্রবর্তন এবং বাজারজাত করা হয়। ১৯৫৫ সালে এলএসডির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা প্রকাশ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী এলএসডি ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। সব ধরনের মাদকাসক্তের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল। ঠিক একইভাবে এলএসডির চিকিৎসাও ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। মাদকাসক্ত ব্যক্তির প্রধান চিকিৎসা হলো কাউন্সেলিং। এছাড়া মেডিকেশন, শারীরিক ব্যায়াম, আকুপাংচার, মেডিটেশন, ইয়োগা প্রভৃতির মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়ে থাকে।

এবার ফিরে আসি মোবাইল বিক্রেতা ব্যবসায়ীর কথায়। হাসপাতালে তার চিকিৎসায় ধরা পড়ে মাদকাসক্তের বিষয়টি। মুহূর্তে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন না কত দিন ধরে তিনি এ অন্ধকার পথে আছেন। কেন পরিবারের কেউ বুঝতে পারল না, একে অন্যকে দোষারোপ করা প্রভৃতি। পরিবারের মধ্যে অবিশ্বাস আর সন্দেহ দেখা দেয়, শুরু হয় অশান্তি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেয়ার পর একে একে পরিষ্কার হয় সবকিছু। পরিবারের সদস্যরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। ভিকটিমের পাশে এসে সহানুভূতির হাত বাড়ায়। সমাজের মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে। সহায়তা করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তবেই সমাজের সবার চেষ্টায় মাদকমুক্ত সমাজ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

পিআইডি নিবন্ধ