নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় বহুতল ভবন ভাঙতে ছয় মাস সময় পেয়েছে তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ওই ভবন থেকে কার্যালয় সরাতে তিন বছর সময় চেয়ে বিজিএমইএ’র করা সময় আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল রোববার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমরা সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।
এর আগে গত ৫ মার্চ ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আপিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে বিজিএমইএ’র রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এর ফলে বিজিএমইএ’র ভবন ভাঙতে সব আইনি বাধা দূর হয়।
অবশ্য রিভিউ খারিজ করে রায় ঘোষণার দিনই ভবন ভাঙতে কত সময় প্রয়োজন, তা জানিয়ে বিজিএমইএ-কে ৯ মার্চের মধ্যে লিখিতভাবে আবেদন করতে বলেছিলেন আপিল বিভাগ। সে অনুযায়ী, ৮ মার্চ বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে তিন বছর সময় চেয়ে আবেদন করা হয়।
গত ৯ মার্চ আবেদনের ওপর শুনানির জন্য আপিল বিভাগ ১২ মার্চ দিন নির্ধারণ করেন। সে অনুযায়ী গতকাল বিজিএমইএ’র পক্ষে আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী তিন বছরের সময় আবেদনের ব্যাখ্যা দেন।
তখন আদালত দক্ষিণ কোরিয়ার ইলেকট্রনিক মার্কেট স্যামসাং ভবনের উদাহরণ দেন। এ সময় হুন্দাই কোম্পানির মালিকের জেলে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে আদালত বলেন, আপনারা শেরাটন কিংবা সোনারগাঁও হোটেলে গিয়ে ভাড়া নেন। ২০১১ সালে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন। এরপর ২০১৬ সালের ২ জুন আপিল বিভাগ তা বহাল রেখেছেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে সরানোর কোনো চেষ্টা করেননি।
এরপর ছয় মাস সময় দিয়ে আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ।
ভবন ভাঙার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ’র আপিল ২০১৬ সালের ২ জুন খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ। একই বছর ৮ নভেম্বর আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ে বিজিএমইএ-কে অবিলম্বে ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় রাজউককে ৯০ দিনের মধ্যে ভবনটি ভেঙে ফেলতে বলা হয়। তবে রাজউক ভাঙলেও খরচ বিজিএমইএ-কে বহন করতে হবে বলে আদালত রায়ে বলেছিলেন। রায়ের অনুলিপি প্রকাশের এক মাসের ব্যবধানে রিভিউ করে বিজিএমইএ। সেই রিভিউ আবেদনও খারিজ হয়ে গেলে ভবন ভাঙা ছাড়া এখন আর কোনো বিকল্প নেই।
মামলার বিবরণে জানা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয়ে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। পরদিন ৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন।
রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। সেই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
হাইকোর্ট রায়ে বলেছিলেন, ‘বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে।’
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে।
হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়।
ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত হয়।
এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে। সেই আপিল আবেদনটি গত বছর ২ জুন খারিজ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ী খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্মাণকাজ শেষে ২০০৬ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভবনটির উদ্বোধন করেন।