সাধন সরকার: আনন্দের বার্তা হলো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা বাজেট বৃদ্ধি, আবাসন সংকট নিরসনে দ্রুত অস্থায়ী হলো নির্মাণ ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা এলেও দাবি বাস্তবায়নে আগের মতো গড়িমসি হলে ঘরে বসে থাকা হবে না বলে জবির শিক্ষার্থী-শিক্ষকের বক্তব্যে ওঠে এসেছে! আশ্বাস দেয়া আর বাস্তবায়ন করা ভিন্ন বিষয়। ২০০৫ সালে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানর পর থেকে পুরোনো হলো উদ্ধার ও শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যার সমাধানে একাধিকবার আশ্বাস দেয়া হয়। যতবারই আবাসন সমস্যার সমাধানে আন্দোলন হয়েছে ততবারই মিলেছে শুধুই আশ্বাস। দাবি মানা ও আশ্বাসের ঘোষণা দিলেই হয় না। আশ্বাসের বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে তার গ্রহণযোগ্যতা।
বিষয়টা এমন নয় যে, জবি শিক্ষার্থীরা আবাসন সংকটের দাবিতে এখন আন্দোলন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০০৫-০৬ সেশনের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দখলে থাকা হলগুলো উদ্ধারে আন্দোলন শুরু করে। প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর এ কে এস সিরাজুল ইসলাম খান তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে হলো উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই থেকে আশ্বাসের শুরু। এরপর দুই যুগ হতে চলল কিন্তু জবির আবাসন সংকটের সমাধান হয়নি। আবাসন সংকটের সমাধানে আন্দোলন কখনো থামেনি। আন্দোলনের মুখে শুধু আশ্বাসই মিলেছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি যে তিরিরেই ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। জবি যখন কলেজ ছিল তখন ১২টি হলো ছিল। একটা সময় রাজনীতির জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে ও প্রভাবশালীদের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি প্রয়োগে একের পর হলো হাতছাড়া হতে থাকে। গত ২০ বছরে জবির শিক্ষার্থীরা পাহাড়সমান বৈষম্যের শিকার হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এমন কথা প্রচলিত আছে, এক সরকারের বা দলের আমলে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়, তাই অন্য সরকার এর উন্নয়ন নিয়ে ভাবে না! আবাসন সংকট সমাধানের দাবিতে গত ২০ বছরে জবির শত শত শিক্ষার্থী-শিক্ষক আহত হয়েছে। ভিসি বদল হয়েছে, সময় গড়িয়েছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের দেয়া আশ্বাস বাস্তবায়ন হয়নি। জবির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যে আন্দোলনে নেমেছেন; তা শতভাগ যৌক্তিক।
২০ বছর ধরে আবাসন সংকট সমাধানের নামে জবির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন করা হয়েছে। কথা দিয়ে যারা কথা রাখে না তা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। ২০০৯ সালে আবাসনের দাবিতে প্রায় এক মাস ধরে চলা আন্দোলনে উত্তাল ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ‘রক্ত নে, হল দে’ স্লোগানে পুরান ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সে সময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের নামে মামলাও করে। হলের দাবিতে ছোট-বড় অনিয়মত আন্দোলন চলতে থাকে। ২০১৪ সালে হলের দাবিতে আবারও ফুঁসে ওঠে জবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা আহত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে। কিন্তু জমিসংক্রান্ত জটিলতায় কোনো ফল আসেনি। ২০১৬ সালে তুমুল আন্দোলনের মুখে কেরানীগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া ইউনিয়নে ২০০ একর জমির ওপর দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণা আসে। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের একটা দাবি ছিল, যত দিন আবাসনের ব্যবস্থা না হয়, তত দিন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর আবাসন ভাতা নিশ্চিত করতে হবে। এবার যেহেতু দাবি মেনে নেয়া হয়েছে সেহেতু শিক্ষার্থীদের আবাসন ভাতাও দিতে হবে। স্বাধীনতার আগে ও পরে বৈষম্য ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবসময় জবি শিক্ষার্থীরা অগ্রভাগে ছিল। ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে চলেছে পুরান ঢাকার এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে এটাও ঠিক, আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যা করছে তা একেবারে যৌক্তিক ও সঠিক ছিল না। আবাসন সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও জোরালো ভূমিকা রাখা দরকার ছিল। পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের জন্য হল রয়েছে ২৩টি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হল রয়েছে ২২টি। সে তুলনায় জবিতে হল রয়েছে মাত্র একটি ( সেটিও ছাত্রীদের জন্য)।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কাঁটছাট না করেই অনুমোদন এবং বাজেট বৃদ্ধির ঘোষণায় সাধুবাদ জানাই। ঢাকার মধ্যে ও আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনায় অর্থাৎ ঢাবি ও জাবির মতো বা তার বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত। বেশি বরাদ্দ থাকা উচিত এই কারণে যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুরুতে তো বিশ্ববিদ্যালয় টিকে গড়তে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের ঘোষণার পর প্রায় ৮ বছর ধরে চলে জমি অধিগ্রহণ। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণে কচ্ছপ গতির কারণে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে আবারও আন্দোলন শুরু করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের নভেম্বর শিক্ষার্থীরা আবারও দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের দাবিতে আন্দোলনে নামে। অবশেষে আন্দোলনের মুখে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের অবশিষ্ট কাজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত সাত বছর হতে চললেও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণে বিভিন্নভাবে কালক্ষেপণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই তাই এটি একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতাভুক্ত করার দাবি জানিয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন নিয়ে বারবার ছিনিমিনি খেলা হয়েছে! যেহেতু দাবির বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা এসেছে তাই আগের মতো যেন কালক্ষেপণ না করা হয়। তিন দফা দাবির দৃশ্যমান বাস্তবায়ন শুরু হোক। দ্রুতই আবাসন সংকট নিরসনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কষ্টের সমাপ্তি হোক।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রথম ব্যাচ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়