জনমিতির সুবিধা পেতে তরুণ প্রজন্মকে দেশে রাখা জরুরি

আবুল কাসেম হায়দার: দেশের তরুণ সমাজ আজ হতাশ। কিন্তু কেন? এত উন্নয়ন কি তরুণ সমাজকে আনন্দ দিতে পারল না। এসব দেখে তরুণ সমাজ দেশ নিয়ে কি ভালো চিন্তা করার সুযোগ পেল না। কিন্তু কেন পেল না তা আজ আমাদের দ্রুত তলিয়ে দেখা দরকার। তরুণেরা কি সব দেশ ছেড়ে চলে যাবেন?

সম্প্রতি তরুণদের নিয়ে জরিপ: সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা দেশ নিয়ে বেশ চিন্তা করেন গবেষণা করেন। নানা উপায় বের করে পরামর্শ দেন। যারা দেশ পরিচালনা করেন তাদের জন্য এই সকল গবেষণা করা হয়। যাতে দেশ সুন্দরভাবে, পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারে। সম্প্রতি তরুণদের নিয়ে দুটি জরিপ প্রকাশিত হয়েছে। একটি হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘শ্রমশক্তি জরিপ-২০১২ এবং অন্যটি হলো এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম আয়োজিত ‘যুব জরিপ-২০২৩’।

বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী যেখানে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার এক শতাংশের কিছু বেশি, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় বা সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতের মধ্যে বেকারত্বের হার ১২ শতাংশ। বর্তমান দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস বেকারের সংখ্যা ৮ লাখের অধিক।

যুব জরিপ ২০২৩ : যুব জরিপ ২০২৩ উঠে এসেছে তরুণদের নানা অপ্রাপ্তি ও হতাশার বার্তা। যুব সমাজ হতাশ। এই জরিপে অংশ নেয়া ৬ হাজারের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ যুবক বিদেশে যাওয়ার কথা বলেছে।

রাজনীতি নিয়ে তরুণদের হতাশা ও অনাগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। জরিপে মাত্র ১১ শতাংশ তরুণ রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। এই জরিপের তরুণদের ৫৩.৮ শতাংশ জাতীয় নির্বাচনে ৪৬ শতাংশ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি বা দেয়নি। ৫৩ শতাংশের অধিক যুবক রাজনীতি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। রাজনীতির কোনো সভা-সমাবেশে যোগ দেন না। রাজনীতির ওপর কোনো লেখা বা বই পড়েন না। প্রয়োজন মনে করলে রাজনীতি বিষয়ে জানার জন্য এই সকল যুবক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নির্ভর করেন।

অন্যদিকে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম কর্তৃক যুব জরিপ-২০২৩ এ তরুণ সমাজ তাদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে মনে করে এবং এই বিষয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছে। মতামত প্রকাশে দ্বিধা, সংকোচ ও অস্বস্তিতে রয়েছে দেশের ৪৩ শতাংশ তরুণ। আর মতপ্রকাশের কারণে বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন ৩৬.৪ শতাংশ তরুণ। অন্যদিকে ১২ শতাংশের অধিক তরুণ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশে বিভিন্ন আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

জরিপের তথ্য বলে : এই দুটি জরিপ বা অন্যান্য সূত্রের নানা বিবেচনায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের তরুণেরা ভালো নেই। বড়ই অশান্তিতে রয়েছে। ওই দুশ্চিন্তায় রয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, হতাশাগ্রস্ত তারুণ্যের এক বাংলাদেশের ইঙ্গিত বয়ে আনছে। তারুণ্যের এই হতাশা আমাদের দীর্ঘদিনের। বহু জরিপে এই হতাশার চিত্র ফুটে এসেছে। কিন্তু আমরা কি এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছি? রাষ্ট্র কি তরুণদের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করছে?

আমরা জানি, যে কোনো জরিপের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। পরিকল্পনা গ্রহণে সুবিধার জন্য জরিপগুলো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। জরিপ অনুযায়ী রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। পরিকল্পনা গ্রহণে রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু রাষ্ট্রের উদ্যোগ খুবই কম। মাস, বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের উদ্যোগ দৃষ্টিতে আসে না। অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। তাই তরুণদের হতাশা বাড়ছে, কোনোক্রমে হতাশা থেকে দেশের তরুণেরা বের হতে পারছে না।

জাতীয় যুবনীতি২০১৭: বাংলাদেশে ২০১৭ সালে জাতীয় যুবনীতি-২০১৭ প্রণীত হয়েছিল। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরকার শিক্ষিত যুব বেকারত্ব রোধে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। কিন্তু তরুণ সমাজের ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রমাণ করে যে, সরকারের গৃহীত নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর ব্যর্থতার চিহ্ন রয়েছে। তরুণেরা নিয়মিত হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। হতাশা থেকে বাঁচার জন্য কেউবা ভূমধ্যসাগরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেন। কেউবা বিমানে চড়ে চলে যান ইউরোপ আমেরিকার কোনো দেশে। আর একবার বিদেশ যেতে পারলে তারা আর কখনও দেশে ফিরে আসার চিন্তাও করে না।

এখন কী করা জরুরি: বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ, সংখ্যার হিসাবে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় কোটি হবে। এই তরুণেরা যদি সব দেশ ছেড়ে বিদেশ যায় তাহলে নীতিমালা দিয়ে কী হবে? ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা পাওয়ার জন্য এই তরুণ প্র জন্মকে দেশে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এই তরুণ সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের আইন আছে, আছে সুন্দর নীতিমালা। কিন্তু তা বাস্তবায়ন না হলে ড্রইং রুমে শোকেজে সাজিয়ে রাখার মতো ছাড়া আর কী হতে পারে।

তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। স্বপ্ন ছাড়া তরুণেরা অগ্রসর হতে পারবে না। স্বপ্ন দেখানোর জন্য স্বপ্নময়, সঠিক, যোগ্য সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্বের প্রয়োজন। প্রয়োজন তরুণ নেতৃত্বের। তরুণদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বেরিয়ে আনতে হবে। তবেই পরিবর্তনের আশা বাস্তবে রূপ নিতে পারে।

বাংলাদেশের তরুণদের দেশে কাজে লাগাতে হতে অনেকগুলো দ্রুত জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

১.      তরুণদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে আমাদের গড়ে তোলার পরিকল্পনা ও নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।

২.     যোগ্যতা অনুযায়ী তরুণদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৩.     তরুণদের বিদেশ যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাকে পরিবর্তন করার জন্য সুদূরপ্রসারী কার্যকরী, দৃশ্যমান, স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুবই জরুরি, যা দেখে তরুণ সমাজ বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করে দেশ সেবায় নিয়োজিত হবে।

৪.     তরুণ সমাজকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু ডিগ্রিধারী তরুণ তৈরির পরিবর্তে কর্মমুখী তরুণ তৈরি হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে গ্রামে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন থেকে সরে এসে কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। অষ্টম শ্রেণি-পাসের পর দেশের ৪০ শতাংশ তরুণকে কর্মমুখী শিক্ষায় নিয়ে আসার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

গবেষণাকে প্রধান বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি সার্টিফিকেটে প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান না বানিয়ে গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার জন্য কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

৫.     দেশে একটি সুস্থ, স্থিতিশীল, জ্ঞানগর্ব রাজনৈতিক পরিবেশ তরুণ সমাজ অনেক দিন পর্যন্ত আশা করে আসছে। বিগত কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তরুণ সমাজ অংশগ্রহণ করতে পারেনি। প্রায় ৪ কোটি তরুণ ভোটার আজ অস্থির জীবন নিয়ে চলেছে। তাই তাদের মধ্যে হতাশা। বিদেশগামিতা এই হতাশা থেকে সৃষ্টি। স্বদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দিয়েছে। জাতীয় নেতাদের এই বিষয়ে খুব বেশি নজর দেয়া প্রয়োজন। মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি, রাজনীতির জন্য মানুষ নয়। তাই আসন্ন নির্বাচন অতি গুরুত্বপূর্ণ। সব দল ও মতের রাজনীতিবিদদের এই বিষয় সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তবেই দেশের তরুণ সমাজের মনের আশা পূর্ণ হবে।

রাজনীতি দেশের কল্যাণে রাজনীতিবিদরা করেন আমরা বিশ্বাস করি। অনাগত ভবিষ্যৎ রাজনীতি আরও বেশি মানবিক, কল্যাণময় করার ওপর দেশের উন্নতি ও তরুণ সমাজের দেশমুখী করা নির্ভর করবে। মেধাবী তরুণদের দেশের কাজে না লাগাতে পারলে উন্নত দেশ ও জাতি হওয়া খুবই কঠিন। ২০৪১ সালে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে সময় ও বছর আরও গড়িয়ে যাবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি আইএফআইএল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ

সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম