তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল : অন্যকিছুতে শতভাগ বাঙালি না হলেও আমি আবার খাবারের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অর্থাৎ কট্টরপন্থি বাঙালি। একবেলা পেটে ভাত না পড়লে মানসিকভাবেও ক্ষুধার্ত মনে হয় নিজেকে। আর তাই দেশে কিংবা বাইরে যেখানেই যাই আমার প্রথম মিশন হয় একটা বাঙালি হোটেল খুঁজে বের করা, আর সৃষ্টিকর্তার মহান কৃপায় তা পেয়েও যাই! অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে নিজেকে ভাগ্যবান বলতেই হয়। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে পথে-মাঠে-ঘাটে হরহামেশা হয় নিজেই দুর্ভাগা বলে পরিগণিত হই, কিংবা কোনো এক ভগ্নহূদয় দুর্ভাগা মানুষের সঙ্গে দেখা যে হবেই তা নিশ্চিত বলা যায়। মানুষের সঙ্গে গল্প করা বা মেশার অভ্যাসটা সেই ছেলেবেলা থেকে—কী করব ভালো লাগে যে! তো এই কথা বলতে গিয়েই কথায় কথায় নিজের জন্য কত কষ্ট যে কিনেছি বলে শেষ করা যাবে না। তবে দুঃখ একটিই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শোনা ছাড়া করার কিছু থাকে না। যা বলছিলাম, এবারের গল্পের মূলে কিন্তু সেই বাঙালি হোটেল।
কাতারের নাজমায় একটি বাঙালি হোটেলে এক রাতে নৈশভোজ করতে গিয়ে পরিচয় আল আমিনের (প্রকৃত নাম নয়) সঙ্গে। ভদ্র একটা ছেলে। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে। আমি যে টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, ঠিক আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে খাচ্ছিল সে। কথায় কথায় নাম জানলাম, তারপর বাড়ি, তারপর শুনলাম আসল কথা। আল আমিন বাংলাদেশ থেকে ছয় মাস আগে কাতারে গেছে। বাড়ির বড় ছেলে। অনেক দায়িত্ব। দেশে চাকরি হচ্ছে না, তাই বিদেশ গমন। আল আমিনের পরিবারে তার বাবার একটি পানের দোকান আছে এবং তিনিই পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। বাবা, মা, পাঁচ ভাইবোন সব মিলে পরিবারে সাতজন। সবার খরচ আল আমিনের বাবা একাই চালান। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের নূন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। ছোট এক ভাই তিন বোন। সবার পড়াশোনার খরচ জোগানো কি চাট্টিখানি কথা! আল আমিন সবে এইচএসসি পাস করেছে। সেই এসএসসির পর থেকে টিউশনি করে নিজের খরচ জোগাতো। স্বপ্ন ছিল সে নিজের খরচে পড়াশোনা করবে, তাড়াতাড়ি একটা চাকরি নেবে আর তারপর ছোট ভাইবোনদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবে। সে আশায় গুড়েবালি হলো যখন হুট করে এক দিন তার বাবা স্ট্রোক করলেন। বেচারা শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। পরিবারের তখন একমাত্র ভরসা আল আমিন! আর একজন এইচএসসি পাস ছেলেকে কে চাকরি দেবে? তার আছেই বা কে? অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কাতারে কর্মরত চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল বিদেশে যাওয়ার।
তার চাচাতো ভাইয়ের পরিচিত একজন লোক যাকে এককথায় দালাল বলা যেতে পারে, তার সঙ্গে দেখা করে একদিন একটি ম্যানপাওয়ার এজেন্সিতে গেল। ভিসা পাঠাবে তার চাচাতো ভাই। ভিসা এলো ম্যানপাওয়ার এজেন্সির কাছে। এখন সেই দালাল তাকে সে কথা জানিয়ে বলল, সর্বমোট খরচ হবে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা মাত্র! শুনে আল আমিন চোখে সর্ষেফুল দেখা শুরু করল। দেশেও কিছু হচ্ছে না, আবার বিদেশ যেতে এত টাকা খরচ; কী করে করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাড়িতে মা আর অসুস্থ বাবার সঙ্গে কথাটা শেয়ার করল। এও জানালো যে চাচাতো ভাই রমিজ জানিয়েছে, কাতারে বেতন হবে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার রিয়াল। তার মানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০ থেকে ৭৭ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া মালিকের, সুতরাং সে যদি কারও কাছে ঋণও নেয় তা সুদে-আসলে দু-এক বছরে শোধ হয়ে যাবে। আল আমিনসহ তার পুরো পরিবার তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
এলাকার এক দাদন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপের পর আল আমিনের বাবা বাড়ি ও দোকানের দলিল গ্যারান্টি হিসেবে জমা দিয়ে পাঁচ শতাংশ হার সুদে পাঁচ লাখ টাকা ধার নিলেন। অর্থাৎ সুদ গিয়ে দাঁড়ায় মাসে ২৫ হাজার টাকা মাত্র! আহা একজন চাকুরের বেতনের সমান! তো আল আমিন সেই টাকা দালালের হাতে জমা দিল। দালাল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগসাপেক্ষে সবকিছু ঠিকঠাক করে ঠিক ফ্লাইটের আগে আল আমিনকে একটি কাগজে সই করতে বলল। কাগজটি অফার লেটার! সেই অফার লেটার দেখা ও সই করার পর থেকে আজ অবধি আল আমিন একটি রাতও স্বস্তিতে ঘুমাতে পারেনি। কেন পারবে বলুন? চাচাতো ভাই বেতন বলেছিল সাড়ে তিন হাজার রিয়াল আর সেই পত্রে লেখা ছিল এক হাজার ৫০০ রিয়াল! হতাশ আল আমিন ঠিক তখনই দালালকে বলল তার প্লেন খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা ফেরত দিতে, আর এও জানাল যে সে আর কাতারে চাকরি করতে যাবে না। কিন্তু দালাল তাকে সাফ কথা বলে দিল টাকা খরচ হয়ে গেছে ভিসা এজেন্সি…ইত্যাদি ইত্যাদি! তাকে এও বলা হলো যদি একান্ত সে টাকা ফেরত চায় তবে এক লাখ টাকা মাত্র ফেরত পেতে পারে! অন্যদিকে তাকে আবার কিঞ্চিৎ সতর্ক করেও দেয় যে শেখ (কাতারের নিয়োগকর্তা) যদি জিজ্ঞেস করে তবে বলতে হবে, শুধু মেডিক্যাল ও অন্যান্য খরচসহ তার সর্বমোট ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তখনই আল আমিন বুঝে গিয়েছিল তার সঙ্গে এজেন্সি, দালাল এমনকি তার চাচাতো ভাইও বেইমানি করেছে। আপন রক্ত! বিশ্বাসই হয় না আজও।
অনেক ভেবে-চিন্তে কাতারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আল আমিন। সেখানে পৌঁছানোর পর নিজের ১০০ রিয়াল খরচ বাদ দিয়ে বাংলাদেশি টাকায় ৩০ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠায়, যার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। ছয়জনের একটা পরিবার কি পাঁচ হাজার টাকায় চলে! আবার মাসে শুধু যদি সুদ ২৫ হাজার টাকা শোধ করতে পারে তবে কবে আসল টাকা দেওয়া শুরু করবে, কবে ঋণমুক্ত হবে? ভাইবোনদের পড়াশোনা! বলতে বলতে ছেলেটা কেঁদে দিল। আমিও পড়লাম বিপাকে, আমার চোখ না ভিজলেও মনটা যে কাঁদছিল! আমি একটু সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, আর আমার পক্ষ থেকে ওর জন্য মিষ্টি আনতে হোটেল বয়কে বললাম।
আল আমিনের কাছেই শুনতে পেলাম অন্যান্য দেশের যারা ওর সঙ্গে চাকরি করে, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বা ফিলিপাইন থেকে আগত, তারা খুব বেশি হলে বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা খরচ করে এসেছে। অনেকের কোনো টাকা খরচই হয়নি! তার কাছে আরও জানতে পারলাম, অধিকাংশ নিয়োগকারী কোম্পানি নাকি ভিসা-টিকিট সব খরচ বহন করে, আর তাই কাতারে আসতে কম অর্থ খরচ হয় অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের। আর যা খরচ হয়, তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত। তার মনে এখন কয়েকটি প্রশ্ন সব সময় ঘুরপাক খায়—এক. সব খরচ যদি কোম্পানি দেয় তবে এজেন্ট, দালাল এরা কিসের জন্য টাকা নেয়? আর যদি টিকিট নেওয়ায় লাগে বা অন্যান্য খরচ দেওয়াও লাগে, তবে খুব বেশি এক লাখ টাকা খরচ হলেও হতে পারে, তা-ই বলে এত বেশি? দুই. অন্যান্য দেশের কর্তৃপক্ষ যদি এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না? কেউ কি কারও কাছে জিম্মি? তিন. অন্যান্য দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি যদি বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকদের খোঁজখবর রাখতে পারে, তবে বাংলাদেশিদের জন্য কেন এমনটি হয় না? চার. দেশের নেতৃস্থানীয়রা কি কখনও ভেবে দেখেছেন কেন আরব আমিরাত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য অনেক দেশে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রয়েছে? অবস্থার কি কোনো উন্নতি হবে না?
আমার সঙ্গে কাতারের এক কোম্পানির একজন নির্বাহীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, ভদ্রলোকের বাড়ি ভারতে। তিনি তো আমাকে সরাসরি বলেছিনেল, ‘ভাই, শেখরা বাংলাদেশিদের যে কারণে নিতে চাচ্ছে না তার প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশ থেকে আসতে শ্রমিককে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। ভিসা-টিকিট সব খরচ দিয়ে কে শুধু শুধু এত বড় অপবাদ কিংবা ঝামেলা নেবে, বলুন? আবার ইদানীং গালফের শ্রমিকদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো বড় সোচ্চার হয়ে পড়েছে, তাই শেখরা অনেকেই আর ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না।’
আল আমিনসহ বাংলাদেশের যত যুবক বিদেশ গেছে বা যেতে চাচ্ছে সবার জন্য শুভ কামনা রইল। কিন্তু একটা অনুরোধ করব ভাই, লাভ-ক্ষতির হিসাবটা একটু করবেন। আর বাস্তব অবস্থা চিন্তা করুন, এত টাকা কি আসলেই দরকার হয়? কী জন্য দরকার হয়? এর চেয়ে টাকা থাকলে দেশেই ছোটখাটো একটা কিছু করুন না। আপনার পড়শি তো আপনাকে দু’বেলা ভাত দেবে না, তা-ই না। তবে তাদের কটু বাক্যের কথা চিন্তা না করে ছোট হোক বড় হোক একটা কাজ, ব্যবসা করুন। কোনো কাজই ছোট নয়। জানেন তো, যদিও সরকারি অনুমোদন পায়নি তবুও অনেক বেকার ছেলে এক লাখ টাকা খরচ করে একটা বাইক কিনে তা দিয়ে মাসে আয় করছে অন্তত ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠাও, উবার, মুভ, বাহন, লেট’স গো প্রভৃতিতে রেজিস্ট্রেশন করে। কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে বিবেচনা করে এসব সার্ভিস একসময় অনুমোদন দেবে সরকার। এছাড়া আরও কত কাজ আছে, ঢাকা শহরে রাস্তায় যে চা বিক্রি করে, যে ফেরি করে, তার সংসার কীভাবে চলে, তা ও ভেবে দেখুন। রাজধানীর ব্যস্ততম কোনো একটি জায়গায় কিংবা অলিগলিতে একজন পানের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিন, তার দোকানভাড়া কত। দেখবেন, দোন ভাড়ার দু-তিন গুণ পরিমাণ কিংবা আরও বেশি অর্থ মাসে আয় করেন ওই দোকানি। তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আর সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, ম্যানপাওয়ার এজেন্সি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত দালালদের ওপর দয়া করে নজরদারি বাড়ান। সবাই মন্দ নয়, মন্দ লোকের সংখ্যা হাতে গোনা। আর প্রবাসী শ্রমিকদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দূতাবাসকে পরামর্শ দিন। বিশ্বাস করি, জনশক্তি রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও পদক্ষেপ নিতে সরকার যথেষ্ট সতর্ক। আমরা জানি, বিদেশে পাঠানো জনশক্তির সিংহভাগ কায়িক শ্রমনির্ভর ও নিরীহ—এসব কর্মী পাঠানোর মধ্যপ্রাচ্যই আমাদের জন্য সুবিধাজনক জায়গা। আমাদের প্রত্যাশা, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমজীবীদের স্বার্থ সংরক্ষণে আমাদের দূতাবাসগুলোও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক
chanchal.song@gmail.com