মো. জিল্লুর রহমান: আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলে সারা বিশ্বের জনমানুষের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পরিষদ এ দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের লক্ষ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আসলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, পরিকল্পিত উপায়ে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করাই প্রতিটি দেশের বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জনসংখ্যা কখনই সমস্যা নয়, এটি হলো সম্পদ। কেননা জনসংখ্যাই হতে পারে জনসম্পদ।
স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে বেসরকারি পর্যায়ে এই কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। একপর্যায়ে এই কার্যক্রমে বেশ সফলতা আসে এবং সাম্প্র্রতিককালেও এই কার্যক্রম চলছে। তবে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে সচেতনতা নেই বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত-সচেতন দম্পতিও অধিক সন্তান নিচ্ছেন। একটি দেশের মূল অবকাঠামো হচ্ছে জনসংখ্যা। যদিও বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়া এক ধরনের আতঙ্কের খবর। বলা হয় একুশ শতাব্দীতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থার জš§ দিতে চলেছে।
তবে স্বস্তির খবর হলো বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের মাইলফলকের তুলনায় বেশ কম। যেখানে ১৯৬৩ সালে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি, ২০২২ সালে এসে এ হার দাঁড়িয়েছে মাত্র দশমিক ৮ শতাংশে। বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিভিন্ন। কিছু দেশে বৈশ্বিক হারের চেয়ে বেশি, আবার কোথাও কম, এমনকি উদ্বেগজনকভাবে কোথাও জনসংখ্যা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। জনসংখ্যায় শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক কম, সেই সঙ্গে মানুষের আয়ু বাড়ছে। মূলত এ কারণেই শিশুর তুলনায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। পাশাপাশি এখন নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে গড়ে ১০০ কন্যাশিশুর জšে§র বিপরীতে পুরুষ শিশুর জš§ হয় ১০৬। যদিও প্রত্যাশিত আয়ু আবার নারীর বেশি।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্বেগজনক চিত্র হলো জš§হার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। তবে সব দেশেই কম বেশি এ হার কমছে, এমনকি অনেক দেশেই ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে প্রতিজন নারীর বিপরীতে জš§ হতো ৫ শিশুর, সেখানে ২০২২ সালে এটি ২.৩। ২০৫০ এ আরও কমে ২.১ এ নেমে আসবে। সেই সঙ্গে একদিকে কম শিশুর জš§ হচ্ছে, আবার মানুষের আয়ু বাড়ছে। ফলে জনসংখ্যায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং এর বিপরীতে বর্তমানে জনসংখ্যায় শূন্য থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর হিস্যা ক্রমেই কমছে।
বর্তমান বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জনসংখ্যা কমছে বলে জানা যাচ্ছে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে জনসংখ্যা কমে যাওয়ার এই প্রবণতা কোনো ধরনের হুমকি না হলেও, এটি বিশ্বের জন্য বিরাট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। যেসব দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে সেগুলোÑ চীন, গ্রিস, পর্তুগাল, জাপান, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি এবং ইউক্রেন অন্যতম। জাতিসংঘের পপুলেশন প্রসপেক্ট ২০২২ নামে এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ২০২২ থেকে শুরু করে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৬১টি দেশের জনসংখ্যা ১ শতাংশ কমবে। প্রজনন হার কমে যাওয়া এবং বড় মাত্রায় অভিবাসনই জনসংখ্যা কমে যাওয়ার বড় কারণ।
বাংলাদেশে ২০২২ সালের ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতি মিনিটে জনসংখ্যা বাড়ছে ৪ জন। ১৯৬১ সালে যেখানে জনসংখ্যা ছিল ৩ কোটির ওপরে, সেখানে ২০২২ সালের ষষ্ঠ জনশুমারীর তথ্যমতে বাংলাদেশে ১৬,৫১,৫৮,৬১৬ জন মানুষের বসবাস অর্থাৎ জনসংখ্যা বেড়েছে পাঁচগুণের বেশি। ফলাফল অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারীর সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ১২ হাজার ৬২৯ জন। এছাড়া, বর্তমানে প্রতি ১০০ জন মহিলার বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৮ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২ শতাংশ, যা গত দশকের ১.৩৩ শতাংশ তুলনায় কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ২০২২ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১.৭৪ শতাংশ এবং বরিশাল বিভাগে সর্বনি¤œ ০.৭৯ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রতি বর্গকিমিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ১১৯ জনে উপনীত হয়েছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে প্রতি বর্গকিমিতে ২ হাজার ১৫৬ জন এবং সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে প্রতি বর্গকিমিতে ৬৮৮ জন।
জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রজনন সক্ষমতা কমে গেছে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এখন এমন দেশে বাস করে যেখানে প্রজনন সক্ষমতার হার ২.১ শতাংশের নিচে। কোনো দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যতে রাখতে হলে প্রজনন সক্ষমতার হার ২.১ থাকতে হয়। এছাড়া অভিবাসনও জনসংখ্যা কমে যাওয়ার একটি বড় কারণ। যে দেশে অভিবাসীদের সংখ্যা কম সেখানে জš§হার কম হয়। কারণ এই অভিবাসীরা সাধারণত তরুণ হয় এবং তারা সন্তান জš§দানে সক্ষম। চীন আর জাপানে অভিবাসনের সুযোগ কম থাকায় অন্য দেশের তুলনায় সেখানে মানুষ কম। এ কারণে তাদের জনসংখ্যাও কমছে। একই চিত্র হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডে। এই দুটো দেশেও নাগরিকদের সন্তান জš§দানে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এছাড়া যেখানে দারিদ্র্য কম, জনস্বাস্থ্যের সুযোগ ভালো, শিক্ষার হার বেশি, জš§নিয়ন্ত্রণ সরঞ্জাম সহজলভ্য, লিঙ্গ বৈষম্য নেই, সেখানে মানুষ সন্তান জš§দানে আগ্রহী কম হয়। একই ভাবে যেখানে জš§হার বেশি থাকে সেখানে এসব সুবিধাও কম থাকে। উন্নত যেসব দেশে জš§হার কম সেখানে নারীদের কর্মসংস্থান বেশি এবং তারা সন্তান জš§দানকেই একমাত্র কাজ হিসেবে মনে করে না। এছাড়া আধুনিক জীবনযাপনও কম জš§হারকে উৎসাহিত করে। বিশেষ করে যেখানে অধিক কর্মঘণ্টা এবং শিশু যতœকেন্দ্রের অপর্যাপ্ততা রয়েছে সেখানে জš§হার কম। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ চীন এবং জাপান, যেখানে সন্তান লালন-পালন বেশ কষ্টসাধ্য।
চীনে গত ৬০ বছরের মধ্যে প্রথমবার জনসংখ্যা কমার খবর গণমাধ্যম প্রকাশিত হয়েছে। চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, দেশটিতে বর্তমানে ১৪১ কোটির কিছু বেশি মানুষ বাস করে। ২০২২ সালের তুলনায় যা প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কম। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে জš§হার কমে যাওয়া। দেশটিতে বর্তমানে প্রতি এক হাজারে জš§হার মাত্র ৬.৭৭। অন্যদিকে জাপানে ২০১০ সাল থেকেই জনসংখ্যা কমছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে দেশটিতে প্রায় ৮ লাখ মানুষ কমেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে শিশু জš§ দিলে নগদ অর্থসহ সুবিধা বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তারপরও জাপানি জনগণকে সন্তান জš§দানে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।
জনসংখ্যা একটি দেশের জন্য আশীর্বাদ ও অভিশাপ দুটোই হতে পারে। যখনই দেশের সম্পদ দেশের জনগণের তুলনায় অপ্রতুল হয়ে যায়, তখনই দেশে জনসংখ?্যার বিস্ফোরণ হয় এবং এই বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি হয়ে পড়ে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরাও ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখতে হলে প্রথমে তাদের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণ জানতে হবে। প্রথমত, সমাজে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, ছেলে সন্তানের লোভে অধিক সন্তানের জš§ দেয়ার মতো কুসংস্কার রয়েছে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এছাড়া কুসংস্কারের বিভিন্ন বেড়াজাল যে সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে, তার অন্যতম কারণ অশিক্ষা বা কার্যকরী শিক্ষার অভাব। যখন দেশের মানুষের গড় আয়ু কম হয় এবং শিশুমৃত্যুর হার বেশি হয়, তখনও দেশের জনগণ অধিক সন্তানের প্রতি আগ্রহী হয়। দরিদ্রতার হার বেশি আর নারীর মতামতের প্রাধান্য না থাকাও জনসংখ্যা বিস্ফোরণে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।
কানাডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশসমূহ, জাপান, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি উন্নত দেশগুলোতে জš§হার ও মৃত্যুহার খুব কম হওয়ায় জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি খুবই কম। উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যার এরূপ স্বল্প বৃদ্ধির কারণগুলো হলোÑশিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার হার অনেক বেশি গড়ে ৯৫-১০০ শতাংশ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদ উৎপাদনের পরিমাণ খুব বেশি, জাতীয় আয় ও মাথাপিছু গড় আয় অনেক বেশি, জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ায় মানুষের গড় আয়ু বেশি, উন্নত অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সামাজিক মর্যাদা ও চাকরির সুযোগ উন্নয়নশীল দেশের নারীদের তুলনায় বেশি থাকায় সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে মহিলাদের মতামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই উন্নত দেশগুলোতে জš§হার নিয়ন্ত্রিত এবং বর্তমানে অনেকে দেশে ঋণাত্মক বা নি¤œগামী যা এসব দেশের জন্য উদ্বেগজনক চিত্র।
উন্নত দেশগুলোতে মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উল্লিখিত কারণে উন্নত দেশের জনসংখ্যা প্রায় স্থিতিশীল। আবার কোনো কোনো দেশের জš§হার মৃত্যুহার অপেক্ষা কম হওয়ায় জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ঋণাত্মক প্রকৃতির। উন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যা পিরামিড লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ১৫ বছরের কম বয়সী জনসংখ্যা কম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশগুলোকে নানা সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
মূলধন ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নির্ভর করে দক্ষ জনসম্পদের ওপর। তাই দক্ষ জনসম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান ও অপরিহার্য শর্ত। অতিরিক্ত জনসংখ্যার দক্ষতা বাড়াতে গেলে অনেক সময় সম্পদেরও প্রয়োজন হয়। কিন্তু জনসংখ্যা কম হলে সীমিত সম্পদ দিয়েও তাদের দক্ষ করে তোলা সম্ভব হয়। এজন্য পরিকল্পিত উপায়ে জনসংখ্যাকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করাই হোক জনসংখ্যা দিবসের মূল লক্ষ্য।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক
zrbbbp@gmail.com